বৃহস্পতিবার ● ২৫ মে ২০১৭
প্রথম পাতা » আইন ও অপরাধ » সাহসিকতা দেখিয়ে বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে দিলো ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারাজানা
সাহসিকতা দেখিয়ে বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে দিলো ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারাজানা
বিশেষ প্রতিনিধি: বাল্য বিয়ে থেকে নিজেকে রক্ষা করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন ভোলা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানা আক্তার (১৩)। তিনি নিজেই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তার ভেঙ্গে দেন বিয়ে। এ ঘটনায় পুরো শহর জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ফারজানা বলেন, আমার স্বপ্ন লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হবো। কিন্তু বাবা-মা জোর বিয়ে ঠিক করে দেয়, কিন্তু বিয়ে নয়, পড়ালেখা করতে চাই। তাই স্বপ্ন পূরন করতেই বিয়ে বন্ধ করার উদ্যোগ নেই। মঙ্গলবার ও বুধবার এ ঘটনা ঘটে।
দুরন্ত সাহসি ফারজানা আক্তার বলেন, তিনি সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের কানাইনগর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সিরাজ পঞ্চায়েতের মেয়ে ও ভোলা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। নিয়মিত স্কুলে এসে লেখাপড়া চলছিলো তার। খেলাধুলায় মেতে উঠতো সহপাঠিদের সাথে। কিন্তু হঠাই করেই যেন সে হাসি আনন্দ হারিয়ে গেলে। ফারজানা জানায়, একদিন আমার মা জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছ থেকে শুনতে পাই চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারী বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু কার সাথে বিয়ে হলো, বর কে সে বিষয়ে কিছুই জানতাম না।
এর প্রতিবাদ করতে চাইলে মা জান্নাতুল ফেরদৌস ও খালা বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি দেখাতো। তাকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাতো এবং স্কুলে আসতে বাধা সৃষ্টি করতো। যার ফলে বিদ্যালয়ে ফারজানা আক্তারের উপস্থিতি ছিলো কমে যায়।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার (২৩ মে) সকালে ফারজানার মা তাকে বলে রাতে তোর জামাই আমাদের বাড়িতে আসবে। কথাটি শুনে ফারজানা আতঙ্কে উঠে। জামাই আসা উপলক্ষে বাজার সদাই করা হয়। কাউকে কিছু না বলে ফারজানা সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ওই দিন সকালে ভোলা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে বিষয়টি শিক্ষকদেরকে জানায়। সবকিছু শুনে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শরমিন জাহান শ্যামলী বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি আদিল হোসেন তপুকে জানান। আদিল হোসেন তপু সংগঠনের অন্যান্য লোকজন নিয়ে বিদ্যালয়ে ছুটে যান এবং বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সাধারন সম্পাদক এম শাহরিয়ার জিলনকে স্কুলে আসার জন্য বলেন। এই বিয়ে বন্ধ করার জন্য ফারজানা আক্তার জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি চিঠি লিখে। পরে ওই ছাত্রী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুব্রত কুমার সিকদারকে বিষয়টি জানান। তিনি এডিএম মোঃ আবদুল হালিমকে বিষয়টি দেখার জন্য দায়িত্ব দেন।
পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি ফোর্স সহ ওই ছাত্রীর বাড়ীতে যান। বাড়িতে গিয়ে ফারাজানার পিতাকে না পেয়ে মা জান্নাতুল ফেরদৌসকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে এসে বাল্য বিয়ে সম্পর্কে তাকে বুঝানো হয় এবং ১৮ বছরের আগে বিয়ে পড়াবে না এই মর্মে মুছলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বুধবার (২৪ মে) ফারজানার পিতা মোঃ সিরাজ পঞ্চায়াতকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়। পরে জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন তাকে বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে অবহিত করেন। সিরাজ পঞ্চায়েত তার ভুল বুঝতে পারেন এবং ১৮ বছরের আগে মেয়েকে বিয়ে দিবেন না বলে অঙ্গীকার করেন।
এসময় জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন ও স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক মাহামুদুর রহমান ওই ছাত্রীর লেখাপড়ার জন্য সিরাজ পঞ্চায়াতের হাতে আর্থিক অনুদান তুলে দেন। এছাড়াও জেলা প্রশাসক মোঃ সেলিম উদ্দিন ইউনিসেফেরে সহায়তা ও কোস্ট্র ট্রাস্টের বাস্তবায়নে ইসিএম প্রকল্প থেকে ফারজানা আক্তারের লেখাপড়ার জন্য শিশু সুরক্ষা বৃত্তি দেওয়ার আশ্বাস দেন।
বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ লাইন অধিদপ্তর ঢাকা এর কর্মকর্তা সামছিয়ারা বেগম শিখা বলেন, ১০৯৮ সহায়তা ফোনে শিশু ও শিশুর মায়ের সাথে কথা বলে বিভিন্ন পরামর্শ দেই এবং ওই শিশু বিবাহ বন্ধে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কাজ করেছি।
বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি ও কোস্ট্র ট্রাস্টের ইসিএম প্রকল্পের ধনিয়া ইউনিয়ন সমন্বয়কারী সাংবাদিক আদিল হোসেন তপু বলেন, ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানা যে সাহসিকতা দেখিয়েছে তা অন্যান্য শিশুদের জন্য উদাহরন। প্রত্যেকটি শিশুর অধিকার আছে পড়ালেখা করার। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। যে শিশু সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আগামী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। বাল্য বিয়ে দিয়ে সে শিশুদেরকে অন্ধকারে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। তাই শিশুদেরকে বাল্য বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট সাহাদাত শাহিন বলেন, ভোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানা আক্তার নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। প্রত্যেক শিশুর উচিৎ ফারজানার মতো সাহসিকতা দেখিয়ে এভাবে বাল্য বিয়ের অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। তাহলেই ওই সব শিশুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমরা আশা করবো ফারজানার মতো বাল্য বিয়ের আশঙ্কায় থাকা মেয়েরা এভাবে এগিয়ে এসে বাল্য বিয়ে বন্ধে ভূমিকা রাখবে।
জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানা তার দুরান্ত সাহসিকতা দেখিয়ে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তার এই সাহসিকতাকে সাধুবাদ জানাই। প্রত্যেকটি মেয়ে যদি তার জায়গা থেকে বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে এভাবে স্বোচ্চার হয় তাহলে বাল্য বিয়ের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। ফারজানার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় আমরা তার পাশে থাকবো।
-এএইচটি/এফএইচ