

শুক্রবার ● ৯ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » চরফ্যাশন » শীতের ভ্রমণ চর কুকরি মুকরি
শীতের ভ্রমণ চর কুকরি মুকরি
বিশেষ প্রতিনিধি: অস্তগামী সূর্য তার স্বভাবসুলভ ব্যস্ততায় টুপ করে ডুব দিল। দিনের আভা কাটতে না কাটতেই ক্যাম্পের চারপাশে শুরু হল শেয়ালের আনাগোনা। একবার কিছুক্ষণের জন্য শেয়ালদের সম্মিলিত ডাক শুনলাম। তারপর সব চুপ। ক্যাম্পের চার দিকে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নিয়ে শিয়ালের দল ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করল। শুনেছি সঙ্গবদ্ধ শেয়ালের চরিত্র অনেকটা হায়েনার মত হয়। আমরা কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সারারাত পালাক্রমে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পর্যাপ্ত শুকনা কাঠ থাকায় সারা রাত ধরে জ্বলেছে ক্যাম্প ফায়ার। সাথে আড্ডা আর উপরি হিসেবে গান। দুই নবদম্পতি গল্প শুনালেন তাদের ভ্রমণ, পরিচয়, প্রেম আর বিয়ের গল্প। ৪ জনের বিয়েও হয়েছে একই দিনে। বসন্তকাল, ভরা জ্যোৎস্না, বনে ক্যাম্প, আবহ ঠিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের মত ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে’
আমরা ক্যাম্প করেছিলাম ডাকাত খালের শেষ মাথায়, কালির টেক, নারিকেল বাগানের পাশে। ৩/৪ জন ভ্রমণসঙ্গী গাছে হেমক বেঁধে শুয়ে পড়লেন। কুকরি বড় বাজার থেকে আমাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা; তাই রান্নার ঝামেলা নেই। রাতে ভরপুর খাবার সামুদ্রিক মাছ, আলুভর্তা, ঘনডাল, কাঁকড়া ভুনা, চিংড়ি ভুনা আর ভাত। তিনদিনের ট্রিপের সবচে স্বাদু খাবার।
চর কুকরী মুকরী দেশের পুরানো চর গুলোর অন্যতম। প্রায় ৭০০ বছর আগে এ চর ছিল পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি। কালক্রমে চরের ভাঙাগড়ার খেলায় এ চরটি একসময় পুরোপুরি ভেঙে যেয়ে আবার নতুন করে ১৯১২ সালে জেগে ওঠে। মাঝের নিমজ্জিত সময়টুকু বাদ দিলে এ চর ভোলা জেলার মূল ভূখণ্ডের চেয়েও পুরনো। নতুন করে জেগে উঠার পর জলদস্যুরা আবারও এ চরকে দীর্ঘদিন তাঁদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে বন সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ দ্বীপে বনায়ন শুরু করেন এবং ১৯৮৯ সালে ৩ লাখ ৬০ হাজার একর ম্যানগ্রোভ (শ্বাসমুলীয়) বনায়নের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে। এখন এ চরে ঘনবন। গাছের আকৃতি বলে দেয় সামুদ্রিক ঝড় ও প্রতিকূলতা সয়ে তারা শুধু বয়স্কই হয়নি, আকৃতিতে বড় ও ওজস্বীও হয়েছে। বনবিভাগের হিসাব মতে এ দ্বীপে বর্তমান বনভূমির পরিমাণ ৮৫৬৫ হেক্টর; যার ২১৭ হেক্টর বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম। স্থানীয় জেলেরা বললেন- যখন দল বেঁধে বানর নামে তখন এ চরের বনভূমি দিয়ে একা হাঁটা খুবই বিপদজনক। এ চরের উপযোগী বনায়নের গাছ নির্বাচনের জন্য বন সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গবেষণাও করেছে বেশ। নারিকেল বাগান, ঝাউ বাগান, আম বাগান, এ গবেষণারই ফলাফল। বাঁশ, বেত, খেজুরসহ বনজ বিভিন্ন গাছের বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য নিয়ে নিরীক্ষাও হয়েছে ঢের।
এ চরের বন্যপ্রাণী বলতে প্রধানত হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বিভিন্ন জাতের সাপ। শীতে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখী এ দ্বিপের আশেপাশে অবস্থান নেয়।
চরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটির নাম ভাড়ানি খাল। প্রধান বাজারের নাম কুকরী বড় বাজার। বাজারে ঘণ্টা চুক্তিতে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। মহিষের দুধ আর সে দুধের চা আপনাকে আলদা তৃপ্তি দেবে। মহিষের দুধ সবার পেটে সমান ভাবে সয় না। তাই সাবধান, মজা লাগলে প্রথমেই বেশি খেয়ে ফেলবেন না।
এ ট্যুরটির আয়োজক ছিলেন ট্রেকার্স অব বাংলাদেশের। এই প্রথমবার এ গ্রুপের সাথে আমার ঘুরতে বের হওয়ার সৌভাগ্য হল। তরুণ নেতৃত্ব। আমার চাইনিজ বসের মত ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে আনন্দ ও উপভোগের মাত্রা ছিল পরিপূর্ণ। তিন দিনের ট্যুরে এত কম খরচ হয়েছে যে পরিমাণটা বলার সাহস পাচ্ছি না। তাতে সামনের বার এ গ্রুপের কোন ট্রিপে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
যেভাবে যাবেন এখানে একা যাওয়া সম্ভব না। বা অনেক ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। সবচাইচে সহজ হয় কোনো একটা ভ্রমণ টিমের সাথে যোগ দিয়ে দেওয়া।
পিডি/এফএইচ