

রবিবার ● ৯ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » অর্থনীতি » ভোলায় মহিষ পালনে স্বাবলম্বী হাজারো মহাজনেরা
ভোলায় মহিষ পালনে স্বাবলম্বী হাজারো মহাজনেরা
বিশেষ প্রতিনিধি: ধান সুপারি ইলিশের গোলা এই তিনে দ্বীপ জেলা ভোলা। আর ভোলার অনন্য ঐতিহ্য ‘মহিষ পালন’। জেলার সাত উপজেলার ৬১ টি বিছিন্ন দ্বীপ চরগুলোতো মহিষ পালনের পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কয়েকশত বছর ধরে মহিষ বাতান আকারে পালন করে আসছেন মহাজনরা। জেলায় রাখালদের তত্ত্বাবধানে ছোট বড় ১৭২ টি মহিষের বাতানে শতাধিক থেকে শুরু করে হাজার পর্যন্ত মহিষ পালন হয়ে থাকে। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বসত বাড়ির গোয়ালঘরে পালন করতে শুরু করেছেন। আর সোয়া লক্ষ মহিষ পালনের সাথে বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন জেলার ১৬ হাজার মানুষ। মহিষ পালনের ব্যাপকতায় এলাকার দরিদ্র মানুষরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। একদিকে মহিষ বিক্রি অন্যদিকে মহিষের দুধ বিক্রির টাকায় মহাজনরা দেখছেন ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে , জেলার ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন, লালমোহন, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় প্রায় ৬১ টি বিচ্ছিন্ন চর রয়েছে। এসকল চরগুলো নদীর মাঝখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হওয়ায় বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ ঘাসের সমারোহ। তাই এসকল চরগুলোতে পালন করা হয় হাজার হাজার মহিষ। সবুজ ঘাস খেয়ে পালিত হয় এসকল মহিষ। যুগ যুগ ধরে বংশপরপ্রমাক্রমে বহু পরিবার এখানে মহিষের দুধ ও দই বিক্রির পেশায় নিয়জিত রয়েছেন। অনেকে আবার নিজস্ব মহিষের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন করে দই তৈরি স্বাবলম্বীও হয়েছেন বহু মানুষ। দুধ আর দই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরে গড়ে উঠেছে শত শত মহিষ নিয়ে বাতান। প্রতিদিন সকালে বেলা বাড়ার সাথে সাথে এসকল বাতান থেকে মণে মণে দুধ আসতে শুরু করে শহর ও স্থানীয় বাজারগুলোতে। গ্রামাঞ্চলে হাটের দিনে মহিষা দই এর টালির পসরা সাজিয়ে বসেন অনেক বিক্রেতারা। বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয় মহিষের দুধের দই।
সূত্রে জানায়, প্রায় ১২৫০ সালে বঙ্গোপসাগর মোহনায় জেগে উঠে দ্বীপ জেলা ভোলা। এর পর থেকে এখানে গত ৪০০ বছর ধরে ক্রমশই জনবসতি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হলে তারা মহিষ, গরু, ছাগল পালন শুরু করেন এখানকার মানুষরা। ভোলা দ্বীপ হওয়াতে এখানকার ছোট বড় অসংখ্য চরে মহিষ পালনে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষ করে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারগুলোর শত শত মহিষ পালন করে।
স্থানীয়দের ধারণা, প্রায় বিগত ২০০ বছর ধরে স্থানীয়রা মহিষের দুধ থেকে কাঁচা দই উৎপাদন শুরু করে। যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময়েও সমান জনপ্রিয়। এখানে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ এমন কোন অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়নি। এতেই বোঝা যায় এখানে এটা কত জনপ্রিয়।
মহিষ পালনে জীবন বদলে যাওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে ভোলার চরের আব্দুল রশিদ বলেন, মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০১ সালে তিনি চারটি মহিষ নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এখন আমার ৩৬টি মহিষ তার। বর্তমানে তার দুই একর জমি হয়েছে। যার বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা। এ মহিষের দুধ বেঁচে তিনি তার সংসারের খরচ মেটান। ভোলায় এখন মহিষ পালনে চরাঞ্চলের সবাই ঝুঁকছে। এতোদিন শুধু বাতানে পালন হলেও এখন তা বাড়িতে বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশেও পালন হচ্ছে। মহিষ পালনে দিন বদলের এ গল্প জেলার অনেক কৃষকের।
মহিষের বাতান মালিক জাকির হাওলাদার বলেন, তার ৯৫টি মহিষ রয়েছে। এটা আমার দাদা পালন করেছে। তার পর চাচা পালন করেছে। এখন আমি করছি। তবে আগে মহিষ একটু কিছু না হতেই মরে যেত। তাই অনেকে বেশি পালন করতে চাইতো না। কিন্তু এখন কৃমি নাশক ওষুধ ও বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে মহিষ মরার হার অনেক কমে গেছে। একদিকে মরার ঝুঁকি কমেছে। অন্যদিকে মাংস ও দুধের দাম বাড়ার কারণে লাভের পরিমানও বেড়েছে। তাই অনেকের মতো আমারও বেশি মহিষ পালনের আগ্রহ বেড়েছে। আমি এ মহিষ পালন করে প্রায় ৫ একর জমি কিনেছি। যার স্থানীয় বর্তমান বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা।
মহিষের বাতানের মালিক মো. ইউনুছ বলেন, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরে তাদের বাতানে প্রায় আড়াই শত মহিষ রয়েছে। যা তারা চার পুরুষ ধরে লালন করে আসছেন। দৈনিক এখান থেকে ১৩০-১৫০ কেজি দুধ হয়। জেলায় অনেকেই ঐতিহ্য ধারণ করে মহিষ পালন করে আসছেন। যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
স্থানীয় দই বিক্রেতারা বলেন, সাধারণত দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের দই (টালির) চাহিদা বেশি। বর্তমানে দেড় কেজি ওজনের দধি ১৫০ ও দুই কেজি ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দই থেকে মাখন,ঘি ও ঘোল বানানো হয়। মাখনের কেজি ৮০০ ও ঘিয়ের কেজি বার শত টাকায় বিক্রি হয়। এর ভালো দাম পাওয়ায় তাদের লাভও ভালো হয়। তবে দুধের দাম বৃদ্ধি পেলে দইর দামও বাড়ে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, বর্তমানে জেলায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার মহিষ রয়েছে। আর মহিষ পালনের সাথে বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে জেলার ১৬ হাজার মানুষ। আর সবগুলোই জলা মহিষ, এরা মাংস উপাদনের জন্য মহিষ পালন করে অথচ আমরা ইন্ডিয়াতে দেখেছি সেখানে তারা প্রত্যেকটি বাড়িতে নিজেরা গোয়া লঘর করে মহিষ পালন করতেছে। তাদের ৫৩% দুধ আসে মহিষের থেকে বাকি ৪৭% দুধ আসে গরু থেকে। হারিয়ানা, গুজরাট এই সমস্ত এলাকায় তারা উন্নত মুদ্রাজাতের ডেইরী মহিষ পালন করে, তাদের একটি মহিষ থেকে প্রায় ১৮-২০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। তারা মহিষ পালন করে দুধ উৎপাদনের জন্য। আমাদের মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদনের জন্য বাগেরহাট ও টাংগাইলে ২টা মহিষ প্রজোনন খামার আছে। সেখান থেকে ভোলাতে আমরা ১৫০টির মত চেলা মহিষ বিতরণ করেছি, এই চেলা মহিষ দিয়ে বাতানের মহিষগুলোকে কোড়াছ করে উন্নত জাতের মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদনের জন্য কাছ করছি যাহাতে প্রতিটি মহিষ প্রথম থেকেই ১০ থেকে ১৫ কেজি দুধ উৎপাদন করতে পারে। আমরা ভোলা জেলায় খুব দ্রুত ১০০ একর জমির উপর ডি এল আরই ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রাণালয়ের যৌথ উদ্দ্যেগে উন্নত মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদনের জন্য হারিয়ানা গুজরাট থেকে মহিষ আমদানি করে ভোলায় জেলা মহিষের বিস্তার কমিয়ে মুদ্রাজাতের মহিষ উৎপাদন করবো। আমরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, আশা করি ভোলার মহিষের বাতান মালিকরা খুব শিগ্রই এর সুফল পাবে।
-এফএইচ