

শনিবার ● ১৬ জুলাই ২০১৬
প্রথম পাতা » শিল্প-সাহিত্য » ইঁদুর-বেড়াল খেলা : লেখক ও প্রকাশক সম্পর্ক !
ইঁদুর-বেড়াল খেলা : লেখক ও প্রকাশক সম্পর্ক !
ডেস্ক : ভিক্তোর উগোর সেই হ্রস্বতম চিঠিটির উদাহরণ দিয়েই শুরু করা যাক। তিনি তার প্রকাশককে লিখলেন, ‘?’। মানে ‘আমার বই কেমন চলছে?’ উত্তরে রসিক প্রকাশকও দিলেন সংক্ষিপ্ততম সাড়া ‘!’। মানে ‘দারুণ বিক্রি হচ্ছে!’ এ থেকে মনে হতেই পারে লেখক-প্রকাশকের হয়তো এরকম রসেরই সম্পর্ক।
এবার দেখা যাক বাংলাদেশের অবস্থা। লেখকের প্রশ্নবোধক চিহ্নের জবাবে প্রকাশক হয়তো ‘!’ চিহ্নটাই দেবেন। কিন্তু অর্থ হবে একেবারেই বিপরীত ‘ভাইরে অবস্থা খুব খারাপ। আপনার বই এক্কেবারে ফ্লপ!’ কথা কটি যে এমনই হবে তা নয়। প্রবীণ লেখকদের ক্ষেত্রে হয়তো আরেকটু বিনীত বাক্য উচ্চারিত হবে, ‘আশা করেছিলাম আপনার বইটা আরো বেশি বিক্রি হবে। কিন্তু ফলাফল খুব খারাপ।’
কথাগুলো যে সবই মিথ্যা, তা নয়। এসবের মধ্যে সত্যমিথ্যা এত জড়াজড়ি করে থাকে যে, আসল যে কোনটা তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যায়।
এবার আসি বাংলাদেশের বই বাজার প্রসঙ্গে। পাঠ্যবই-নোটগাইডকে এ লেখা থেকে আগেই নির্বাসনে দিচ্ছি। এখানে কথা হবে শুধু সৃষ্টিশীল বইপত্তর নিয়ে। যেখানে উগোর প্রকাশক উনিশ শতকেই বই বিক্রিকে ‘দারুণ!’ বলতে পেরেছিলেন, সেখানে এই একুশ শতকেও আমাদের দেশের প্রকাশকরা, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, ‘নিদারুণ!’ কথাটাই বেশি বলেন। কেন এই অবস্থা? যে দেশের জনগণ ষোল কোটি, সেখানে অনেক খ্যাতিমান লেখকও আছেন যার বই এক বছরে তিনশ’ কপিও বিক্রি হয় না। যদি সত্যিই তা হয়, তাহলে এই অক্ষমতা কার লেখকের না প্রকাশকের?
লেখকের কাজ লেখা। প্রকাশকের কাজ বই প্রকাশ ও বিপণন করা। অনেক সময় লেখকরাও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। নিজেরাই বিপণন করেন। বলা ভালো, বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাসে অনেক লেখকই ছিলেন সফল প্রকাশক। সেই আদি যুগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত সফল প্রকাশক।
অন্যদিকে বাংলাদেশেও কবি জসীমউদ্দীন নিজেই ছিলেন প্রকাশক, যার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তার উত্তরাধিকারীরা। কিন্তু এটি এখন ব্যতিক্রমের তালিকায়ই পড়ে। কেননা, কেবল বাংলাদেশ-ভারতে নয়, এমনকি বিলেতেও বাংলা প্রকাশনা এখন একটি ব্যবসা হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে চাইছে। অনেক পেশাদার মানুষ যেমন এ পেশায় এসেছেন, আবার অনেকেই একে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
এ খাতের অর্থনীতিও নেহায়েত ছোট নয়। তথ্য বলছে, শুধু একুশে বইমেলাতেই ২০১২ সালে প্রায় ২৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এ ব্যবসায় কেবল প্রবীণরাই সফল নন, অনেক তরুণ-নবীন উদ্যোক্তাও বেশ সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন। তবু কেন এ দুরবস্থা, একটু তলিয়ে দেখার ব্যাপার আছে।
বাংলাদেশে এমন অনেক কবি-লেখক-অনুবাদক আছেন, যার বই যথেষ্ট বিক্রি হওয়ার পরও প্রকাশক টাকা দিতে চান না, আবার অনেক লেখক আছেন যাদের বই পর্যাপ্ত বিক্রি না হলেও পয়সাকড়ি ভালোই পান। কারণটা কী? এখানে সম্ভবত নামধাম-ক্ষমতার ব্যাপারটিই মুখ্য। পাঠক না থাকলেও যদি লেখকের মিডিয়ামূল্য ও অন্যান্য ক্ষমতার ব্যাপার থাকে, তাহলে প্রকাশকের মুনাফা হয়তো বহুমাত্রিক, যা শুধু বই বিক্রির মুনাফার চেয়ে বেশি।
তাই যেসব লেখক-অনুবাদক সফল ও বিক্রয়যোগ্য বই করার পরও টাকা পান না, সেই ভাগটা চলে যায় অন্যদের পকেটে। আবার এমন বহু লেখক আছেন, যারা এসব অর্থের ধার ধারেন না। পরন্তু বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য প্রচার বাবদ অনেক বেশি খরচ করেন। আর প্রতি বছর তো এমন বহু দেশি-প্রবাসী নানা ধরনের লেখকের দেখা মেলে, যারা নিজেদের অর্থ দিয়ে প্রকাশকের নামে বই প্রকাশ করেন।
তারপরও কেনো প্রকাশকরা এত নাই নাই করেন? এর বড় কারণ সম্ভবত বিপণন। যে কোনো পণ্যই যত পরিমাণে বিক্রয় হবে, উৎপাদকের মুনাফা তত বাড়বে। আর বইও এক ধরনের বিশেষায়িত পণ্য। অতএব, বিক্রির সঙ্গেই এর বাণিজ্যযোগ। কিন্তু সাধারণ চোখেই দেখা যায়, বাংলাদেশে বই বিক্রির যে হার তাতে মুনাফা ব্যাপারটা খুব সহজ নয়।
ব্যতিক্রম যা আছে, তা পুরো বাণিজ্যের হিসেবে নেহায়েতই কম। ধরা যাক, বর্তমানে বাংলাদেশে যে হারে বইয়ের দাম নির্ধারিত হয় (সাধারণত প্রতি ফর্মা ২৫/৩০ টাকা হারে), তাতে ৩০০ কপি বিক্রি হলেও কেবল প্রকাশনার খরচ ওঠে আসে। কিন্তু এ তো একটা বিনিয়োগ, যার নেপথ্যে মুনাফা প্রধান অনুষঙ্গ। অথচ বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রে একজন প্রকাশকের এক বছরে অনেক বইই এ-সংখ্যক বিক্রি হয় না।
অবস্থাটা এমন যে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ শামসুল হক এক আলোচনায় জানালেন, তার নতুন বইয়ের ক্ষেত্রে অন্তত ৩০৭ জন নির্দিষ্ট পাঠক আছেন। অর্থাৎ তিনি নিশ্চিতভাবে এই পাঠকের কথা জানেন। এর বাইরে নিশ্চয়ই তার অনেক পাঠক আছেন। কিন্তু সংখ্যাটা যে ষোল কোটি মানুষের দেশে হতাশাজনক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাহলে অন্যদের অবস্থা কী? প্রকাশকদের মতে, নিদেনপক্ষে বছরে ৫০০ কপি বই বিক্রি না হলে তাদের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা হয় না। আর এটা অতি অল্প লেখকের ভাগ্যেই জোটে। তাই বলে কি পাঁচশো-হাজার কপি বই বিক্রি হয় না? নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু প্রকাশকদের মতে, বছরে তারা এক-একজন যদি ৩০-৫০টা বই প্রকাশ করেন আর তার মধ্যে যদি মাত্র ৫-১০টা উল্লিখিত পরিমাণ বিক্রি হয়, তাহলে তার চলে কী করে? কথাটার মধ্যে ন্যায্যতা আছে। কারণ দিনকে দিন যে হারে কাগজ-ছাপা-বাঁধাই ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ছে, তাতে করে চিত্রটা সুখকর নয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা, লেখক ও প্রকাশকের দিক থেকে চিত্রটা বেদনার।
একজন প্রকাশকের জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি কী? নিঃসন্দেহে লেখক। কারণ লেখক না থাকলে প্রকাশকের অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু সেই প্রকাশকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কটা বাংলাদেশে কী অম্ল ও মধুর! তবে মধুর চেয়ে অম্লই সেখানে বেশি। মজা করে বললে, বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কটা অনেকটাই টম অ্যান্ড জেরির গেম। কারণ প্রকাশকের অভিযোগ লেখকের বই বিক্রি হয় না, আর লেখকের অভিযোগ প্রকাশক তার রয়্যালটি দেন না।
এটা বাংলাদেশে বহু বছর ধরে প্রচলিত সবচে’ কমন অভিযোগ। বরং বলা ভালো, বাংলাদেশের প্রকাশনার জন্ম থেকেই এটি চলে আসছে। তবে এর বাইরে সৌভাগ্যবান লেখক কি নেই? তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। এদের মধ্যে সৌভাগ্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বাংলাদেশের বই বিপণনের ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর ইতিহাস। তার পরই তার ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
এর বাইরেও বেশ কজন লেখক আছেন, যাদের আবার উঠতি-পড়তি আছে। তবে শুধু লেখাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন এবং কেবল বই বিক্রির রয়্যালটি দিয়ে জীবন পার করেছেন, এরকম লেখক কি বাংলাদেশে কেউ কখনো ছিলেন? জানা নেই। কারণ আমাদের জানা লেখকদের সবাই পাশাপাশি অন্য কোনো কাজ করেছেন অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, নাটক-রচনা, ব্যবসা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে এত পেশা আছে, অথচ ‘লেখক’অর্থে বাস্তবেই কোনো পেশা নেই। কারণ কেবল লিখে জীবন চালানোর কোনো উপায় নেই, যদি না কোনো বিকল্প আয়ের সংস্থান থাকে। এটা কি মর্মান্তিক নয়? এর দায়টা কি কেবল লেখকের? এই যে বাংলাদেশে এত-শত প্রকাশক তারা কি এত বছর বাণিজ্য করে কোনো একজনকে কেবল স্বাধীন লেখকের জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে পেরেছেন?
দু-একজন যারা ব্যতিক্রম তারা নিজের যোগ্যতায় টিকে আছেন, এর জন্য কৃতিত্ব প্রকাশকদের দাবি না করাই ভালো। অবশ্য যারা (সামান্য ব্যতিক্রম বাদে) একজন সম্পাদকই পুষতে পারেন না, তাদের পক্ষে লেখক পোষা তো হাতি পোষারই সমান।
এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গত যুক্তিও আছে, যথেষ্ট পরিমাণ বই বিক্রি না হলে তারা তো আর ঘর থেকে এনে টাকা দিতে পারবেন না। তবে এসবের পরও বাস্তবতা হচ্ছে, বই বিক্রি করেই অনেক প্রকাশক বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। তাদের তুলনায় অধিকাংশ লেখকই যে তিমিরে ছিলেন, সে তিমিরেই আছেন।
প,ড/জেট,অার