

বৃহস্পতিবার ● ৯ জুলাই ২০১৫
প্রথম পাতা » জানা অজানা » জীবনের প্রতিটি পদে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় ওদের ! অবহেলিত এক জনপদের নাম ঢালচর
জীবনের প্রতিটি পদে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় ওদের ! অবহেলিত এক জনপদের নাম ঢালচর
ফরহাদ হোসেন :: ভোলা জেলার বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সবচেয়ে অবহেলিত এক জনপদের নাম হলো ঢালচর। যেখানে নেই কোন রাস্তা ঘাট ও সুসিকিৎসার ব্যাবস্থা। জীবনের প্রতিটি পদে পদে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় এই চরের বাসিন্দাদের। সরজমিনে জানা যায়, ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মেঘনা নদীর বুক ছিড়ে জেগে উঠে প্রায় ৯০ বছর আগে ৩১.৩১বর্গ কিলোমিটারের এই ঢালচর।
তার পর থেকে ভোলা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে বসবাস করতে শুরু করে। সেই সময় থেকে এখানকার মানুষ এখনো একটু ভালো ভাবে থাকার উপায় খুজে বের করতে পারেনি। এখনো এই চরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনেটেশন, যোগাযোগ ব্যাবস্থা, পানীয় জল, নদী ভাঙ্গন ও খাসজমির থেকে শুরু করে হাজারো সম্যসায় কাঁধ বেধেঁ রয়েছে চরবাসী। এসকল সম্যাসা থেকে তাঁরা আজো বের হয়ে আসতে পারছে না। প্রতিনিয়ত হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। এখানে জীবন ধারণের নেই কোন সুযোগ সুবিধা। নেই তেমন ভালো কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এখানার শিশু থেকে শুরু করে অধিকাংশ মানুষের দিন ও রাত কাটে সাগর ও নদীতে মাছ ধরে এবং অন্যানের জমিতে চাষ করে, বাড়িতে গাতর খেটে ও মহাজনদের গরুও মহিষের পাল চরিয়ে। সবদিকে পিছিয়ে রয়েছে চরের লোকজন। এই ৩১.৩১বর্গ কিলোমিটার চরের একাংশে ৩.১০ বর্গ কিলোমিটারে মধ্যে ৮টি আবসন সহ বসতী জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এখানে নামে ৩টি প্রাথমিক, ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি দাখিল ও ১টি কাওমি মাদ্রাসা থাকলে ও শিক্ষার মান একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে। যোগাযোগ, সচেতনতা, আসবাব পত্র সংঙ্কট, ম্যানেজিং কমিটির উদাসীনতাও চরের বাহিরের শিক্ষকদের জাতায়েত ব্যাবস্থা কারণে শত শত শিশু শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মুখ পিরিয়ে নিচ্ছে।
মাঠে গরুর পালনিয়ে যাওয়ার পথে শাহিন নামের এক শিশু কাছে জানতে চাইলে, সেই জানাই, বাবা নেই, সংসারের অনেক অভাবের কারণে পরের গরু চরাতে হয়। তাই স্কুলে যেতে পারছি না। এই রকম অনেক শিশু রয়েছে সচেতনতার অভাবে বিদ্যালয়ে না গিয়ে গরু ও মহিষের পাল নিয়ে মাঠে ও নদীতে মাছ ধরতে যায়। পশ্চিম ঢালচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেম জানান, এই চরের অধিকাংশ মানুষ সচেতনতার অভাবে শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে জীবিকার তাগিদে নদী ও ক্ষেত খামারে কাজ করতে পাঠাচ্ছে। অভিভাবকরা একটু সচেতন হলে এখানকার শিক্ষার মান আরো বৃদ্ধি পাবে।
উপজেলা সদর থেকে একবারেই এই চরে যাওয়া আসার জন্য একটি মাত্র সার্ভিস (ছোট লঞ্চ) রয়েছে। প্রতিদিন বিকাল ৩টায় দক্ষিণ আইচার চর কচ্চপিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে গিয়ে ২ ঘন্টার ব্যাবধানে পৌছে যায় ঢালচরে এবং পরের দিন সকাল ৯টায় ছেড়ে আসে। চরে নেই কোন রিক্সা, বাইচাইকেলও অন্যনান্য যানবাহণ। মালামাল বহনের জন্য রয়েছে মাত্র একটা ভ্যান গাড়ি। নেই কোন ব্রিজ কালর্ভাট। সুশিলনের উদ্দ্যোগে গ্রামবাসীর সেচ্ছাশ্রমে করা হয়েছে প্রায় ৩ কিলো মিটার রাস্তা। তাও ঘূর্ণিঝড় ও আইলার সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চলাচলের জন্য একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পরেছে। সব মিলিয়ে যোগাযোগ ব্যাবস্থা একইবারেই করুন। আবু সুফিয়ান নামের এক কলেজ ছাত্র জানান,এই চরে যোগাযোগের মাধ্যম হলো প্রতিদিন একটি সার্ভিসও ভালো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে আমাদের চরফ্যাশন উপজেলা সদরে গিয়ে লিখা পড়া করতে অনেক সম্যসায় হচ্ছে। বর্ষা সময় এলে এখান কার মানুষের অবস্থা করুন হয়ে পরে। এই চরে নেই কোন হাসপাতাল। চিকিৎসা বঞ্চিত গ্রামবাসীর একমাত্র ভরসা হলো গ্রাম্য কবিরাজ,ওঝা ও স্বল্প শিক্ষিত হাতুরে ডাক্তার। মোশারফ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী জানান, হঠাৎ কেউ অসুস্থ্য হয়ে পরলে জারুরী ভাবে কোন রুগিকে চিকিৎসা ও হাসপাতালে নেওয়া যায়না। তাও আবার ১ দিনের জন্য সার্ভিসের অপেক্ষা করতে হয়। সকল প্রকার চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত তারা। এব্যাপারে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ছিদ্দিকুর রহমান জানান, আমাদের ঢালচরে ১টি কমিউনিটি কিলিনিক ইতি পূর্বে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। আমরা আবার নতুন করে ঘর ভারা নিয়ে চরবাসির জন্য আমাদের সাধ্যানুযায়ী চিকিৎসা সেবার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
এই চরে আশ্রয়ের জন্য তেমন নেই কোন ব্যাবস্থা। তাই প্রতিনিয়ত বর্ণা, জলোচ্ছাস, সাইক্লোনের মত প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে এই চরে কোন রকমে বেঁচে থাকতে হয় ওদের। এইখানে নামে ১ টি আশ্রয় কেন্দ্র ও আরেকটি সিপিপি সাইক্লোনসেন্টার রয়েছে।আশ্রয় কেন্দ্রটি দখল করে লেখেছে পুলিশ পাড়ির সদস্যরা। এখন ওই আশ্রয়কেন্দ্রের সবচেয়ে বেশি আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়ে পরেছে । যা নদী গর্ভে বিলিন হওয়ার প্রহর গুণছে। ওই চরের বাসিন্দা শাহানুর ও করুনা বেগম জানান,বর্ণা, জলোচ্ছাস প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি হলে আমরাদের খুব আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়ে পরে। তখন অন্যানের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। তাদের অনেক কথা শুনে থাকতে হয়। এই চরে তেমন নেই কোন বৃশুদ্ধপানির ব্যাবস্থা। কয়েক বাড়ি মিলে চাঁদা দিয়ে এনজিইউর কাছ থেকে টিউব অয়েল ক্রয় করে নিতে হয়। আবার এসকল টিউব অয়েল চরের বিভিন্ন বর্ণা ও জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পেলে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তখন এখানে একেই বারে বৃশুদ্ধ পানির সংকট হয়ে পরে।
এই চরে নেই স্বাস্থ্য সম্মত স্যানেটেশন ব্যাবস্থা। এখানকার অনেক বাড়িতে স্যানেটারী লেট্টিন নেই। ছোট বড় নারী পুরুষ সবাই বনের মধ্যে অথবা চরের খোলা মাঠে ও খালের পাশে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে অপরাধবোধ থাকলেও সামর্থের অভাবে কেউ স্বস্থ্য সম্মত পায়খানা বসাতে কিংবা ব্যবহার করতে পারছেনা। চরের চারপাশে নেই কোন বেড়িঁবাধ। যে কারনে অমবস্যাও পূর্ণিমার সময় সাগরের পানি বৃদ্ধি পায় এবং বর্ষার পুরোটাই সময় তাদের থাকতে হয় এক প্রকার পানি বন্দির মতো। আবার ঘূর্ণিঝর ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় চরের উপর ৮/১০ ফুট পানি উঠে যায়।
এই চরের মানুষ গুলো সব সময় নদী ও সাগরের মাছ ধরার উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভলশীল। প্রনিনিয়ত ভয়াল মেঘনার নদী ভাঙ্গনের ফলে বহু লোক এখন তাদের বসত ভিটা, বাড়ী ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরছে। এখন শুধু একটু মাথা লুকানোর ঠাই খোঁজছেন। ঢালচর ইউপি চেয়ারম্যান কালাম পাটওয়ারী জানান, আমরা প্রতিনিয়ত বর্ণা, জলোচ্ছাস, সাইক্লোনের মত প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে এই চরে কোন রকম বেঁচে আছি। আজ এই চর নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে । তাই আমরা আতংঙ্কিত হয়ে পরেছি। এই চরের সাধারণ মানুষ গুলো একটু মাথা লুকানোর ঠাই খুঁজছে। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
এই বিচ্ছিন্ন চরের সাধারণ মানুষ গুলো এখনো এই রকম নানা সম্যসার মধ্যে বন্দি হয়ে রয়েছে। এসকল সম্যাসা থেকে তাঁরা আজো বের হয়ে আসতে পারছে না। প্রতিনিয়ত হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় এই অবহেলিত জনপদ ঢালচর ইউনিয়ন বাসীর।