মঙ্গলবার ● ২ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » অর্থনীতি » মনে পড়ছে,আতিউর রহমান স্যারকে
মনে পড়ছে,আতিউর রহমান স্যারকে
আবদুল্লাহ আল মাসুদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হ্যাকড করে আটশ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনাটি না ঘটলে বুধবার (৩ আগস্ট ২০১৬) বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য একটি স্মরণীয় দিন হতে পারতো। কেননা, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নয়াধারার উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের প্রবক্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সফল গভর্নর ড. আতিউর রহমান এই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সকলের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বীরদর্পে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদায় নিতে পারতেন। যদিও রিজার্ভ চুরির আকস্মিক ও অনাকাঙ্খিত ঘটনায় গত ১৫ মার্চ অনেকটা অভিমান করেই স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি এরই মধ্যে বীরের মর্যাদাই পেয়েছেন। স্বীয় পদ থেকে এ দুঃখজনক বিদায় দেশ-বিদেশে তাঁর হিতাকাঙ্খীদের ব্যথিত করেছে। সবচেয়ে ব্যথিত করেছে তাঁরই সন্তানের মতো প্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বাংলাদেশে পদত্যাগের এমন ঘটনা সত্যিই বিরল!যেখানে সরকারি ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও অনিয়মের দায়ভার মাথায় নিয়ে কর্তাব্যক্তিরা বহাল তবিয়তে পদ আগলে বসে থাকেন, সেখানে ড. আতিউর রহমান সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বলে দেশবাসী মনে করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে গেছেন। দিন কাটাচ্ছেন অনেকটা নিভৃতেই। আতিউর রহমান স্যারকে আজকের দিনটির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাঁর হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণীত ও সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতি ও কৃষি ঋণ নীতিমালায় তাঁর সময়কালে নেয়া নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখায় বর্তমান গভর্নর স্যারকেও তিনি বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে তিনি আগেও অনেক আশাবাদী ছিলেন, এখনও আশাবাদী এবং ভবিষ্যতের জন্যও আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা পরিশ্রমী। তারা অনেক বেশি রিজিলিয়েন্ট। এ দেশের মানুষের মধ্যে একটা সহনীয় ক্ষমতা আছে। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি আছে। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা হলেও এ দেশের মানুষ কাজ করে সেটা পুষিয়ে দেন। সেটির প্রমাণ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে স্থিতিশীলতা। ভারত বা শ্রীলংকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির মধ্যে অনেক উঠানামা হয়। গত সাত অর্থবছর ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৬.৩ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে পৌঁছে গেছে। এমনকি গুলশান ও শোলাকিয়া ট্রাজেডি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না বলে তিনি মনে করেন। ২০০৯ সালের ৩ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর থেকেই তিনি প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি উন্নয়নমুখী ও মানবিক ব্যাংকিং ধারণা প্রবর্তনে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক, অংশগ্রহণমূলক, মানবিক ও জনহিতৈষী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রায় সাত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি সত্যিকারের মানবিক, গরিবহিতৈষী ও উন্নয়নবান্ধব কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক দূর এগিয়ে নেন। তবে, তাঁর আরও অনেক কাজ করার ছিল এবং এখনও আছে। তিনি আশা করেন, বর্তমান গভর্নরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হওয়ার বাকি কাজটুকু সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ছিল তাঁর কাছে সন্তানের চাইতেও বেশি। সাত বছর তিনি সন্তানদের বেশি সময় দেন নি, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছেন। এখনকার কর্মীদের স্বার্থ দেখেছেন। দেশটাকে উন্নত করতে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও ব্যাংকিং খাতকে সুশৃঙ্খল করতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে তিল তিল করে সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে যেতে। তিনি দেশের আর্থসামাজিক ও মানবিক উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে প্রায় সাত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংককে জাতীয় অর্থনীতির এক বিরাট নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে �ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন� কর্মসূচি গ্রহণ ও সামাজিক দায়বদ্ধ কর্মকা-কে মূলধারার ব্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে দেশি-বিদেশি সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ করেন। সাধারণ মানুষ�যারা কোনোদিন ব্যাংকে আসতে পারতো না,এমনকি পথশিশুদের পর্যন্ত ব্যাংকিংয়ের আওতায় আনেন। কৃষকের দশ টাকার অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, প্রকৃত কৃষক, ক্ষুদ্র ও নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিভা বিকাশে ব্যাংকের অর্থায়ন কর্মসূচি গতিশীল করা, গ্রীন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, রপ্তানি উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন উদারিকরণ, সামাজিক দায়বদ্ধ কার্যক্রম, ব্যাংকিং খাতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে নানা সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আর এসব যুগান্তকারী কাজের মাঝেই তিনি ব্যাংকিং সমাজ এবং দেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সময়কালে নেয়া এসব উদ্ভাবনীমূলক কর্মকা-ের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনই প্রমাণ করে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্য এক উচ্চতায় নিতে পেরেছিলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বৈশ্বিক মন্দা,পুঁজিবাজারের সমস্যা,ব্যাংকিং খাতের বিচ্ছিন্ন কিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে আতিউর রহমান স্যারকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। এই লড়াইয়ের কারণে বেশকিছু স্বার্থান্বেষী মহল হয়তো অসন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরো আর্থিক খাতকে তিনি স্থিতিশীল রাখতে পেরেছেন। একইসঙ্গে, তাঁর সময়কালে আর্থিক সেবাবঞ্চিত অনেক মানুষকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দশ টাকার ব্যাংক হিসাব খুলে এক কোটি কৃষককে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা, ষোলো হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ, একটি বিশেষ তহবিল থেকে বর্গাচাষিদের দুই হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ যোগান, এক লাখ কোটি টাকার এসএমই ঋণ বিতরণ, নারী উদ্যোক্তা খাতে নিরব বিপ্লব, সবুজ ব্যাংকিং চালু, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর ত্বরিত আমূল আধুনিকায়ন, সম্পূর্ণ সয়ংক্রিয় অনলাইন আন্ত:ব্যাংক চেক ও ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তরের নিকাশ ও পরিশোধ ব্যবস্থা, অনলাইন ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো, পরিশোধ প্লাটফরমগুলোর আন্ত:সংযোগকারী ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ স্থাপন, দেশব্যাপী দ্রুত তিন কোটির বেশি মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক সৃষ্টির মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বৈপ্লবিক প্রসার, ই-কমার্সের দ্রুত বিকাশ এসব কিছুই এক ধরনের লড়াই করে অর্জন করতে হয়েছে। এই সময়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। ফলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাত নিয়ে তাঁর প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছিলেন। তবে আরও অনেকটাই পথ তিনি হাঁটতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশে ভালো মানুষের কদর নেই। বিদেশিরা যাঁকে সম্মান করে তাঁকে অপমান করতে পারার মাঝেই আমরা আনন্দ খুঁজি। সাত বছর নিরলস পরিশ্রম করে যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মর্যাদা এক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করলেন, এর কোনো মূল্যায়ন না করে নিছক একটি দুর্ঘটনা, যার জন্য তিনি কোনোভাবেই দায়ী নন তার জন্য তাঁকে এ রকমভাবে বিদায় নিতে হলো, যা মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টের। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, কাজপাগল মানুষ যদি একটি মাত্র ঘটনার কারণে চাকরি থেকে সসম্মানে বিদায় নিতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে এ দেশে ভালো মানুষেরা ভালো কাজে উৎসাহী হতে ভয় পাবেন। যাহোক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের তালিকায় ড. আতিউর রহমান স্যারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যদিও এই গভর্নরকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাতে পারে নি। তাই আজকের এই দিনে তাঁকে গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করতেই এই উদ্যোগ। স্যার, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আগের মতোই দেশের সেবা করে যান। আপনার মতো একজন দেশপ্রেমিক, দেশের সত্যিকারের একজন আপনজনের নাম বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ভুলতে পারবে না।