বুধবার ● ২২ জুলাই ২০১৫
প্রথম পাতা » সাক্ষাৎকার » স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
বাংলাদেশে যে ক’জন নারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তার মধ্যে চাঁদপুরের স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার অন্যতম। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসান।
হাসান:একাত্তরে আপনি কী করতেন?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তাম। আমি পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী ছিলাম।
হাসান:স্বাধীনতা যুদ্ধে কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : আমি এবং আমার স্বামী অ্যাডভোকেট তাফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছিলাম। আমাদের তখনই মনে হয়েছিলো দেশের জন্য কিছু করার। অনুভব করেছিলাম ‘স্বাধীনতা’ চাই, চাই-ই। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে আমি আমার এলাকা হাজীগঞ্জে চলে আসি। এখান থেকেই আমি মুক্তিবাহিনীতৈ যোগ দেই।
হাসান:যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনি কী করতেন?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : আমি যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলাম। এছাড়াও যেহেতু আমি ডাক্তারি পড়ছিলাম, স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসা সেবার ভার ছিলো আমার উপর।
হাসান:যুদ্ধকালীন কোনো উল্লেখযোগ্য স্মৃতি সম্পর্কে আমাদের বলুন।
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : ১৯৭১-এর একটি দিনের কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিলো ২৯ সেপ্টেম্বর। বিকেল বেলা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমরা সবাই নৌকায় ছিলাম। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলো জহিরুল হক খান। সেদিন শাহরাস্তির অফিস চিতোষীতে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আমাদের যোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে আমরাই বিজয়ী হই। ক্যাম্প দখল করা হলে আমাকে যখন খবর দেয়া হলো, আমি ক্যাম্পের ভেতরে গেলাম। আগেই আমাদের কাছে খবর ছিলো এ ক্যাম্পে পাকিস্তানীরা কয়েকজন মেয়েকে ধরে এনেছে। যখন আমি ভেতরে গেলাম, দেখলাম ক্যাম্পের একটা অংশে কতগুলো মেয়ে, তাদের গায়ে কোনো বস্ত্র ছিলো না, সারা শরীরে পাশবিক নির্যাতনের চিহ্ন। পরবর্তীতে আমি আমার সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তাদের জামা নিয়ে মেয়েদের করে পরতে দিলাম। ঐ সময় আমার সাথে কোনো ঔষধপত্র ছিলো না। আমরা তখন মেয়েদের নিয়ে পানিয়ারার দিকে চলে গেলাম। সেখানে ক্যাম্পে আমি তাদের সেবা শুশ্রুষা করি। জানা গেলো মেয়েদের বাড়ি চাঁদপুর পার্শ্ববর্তী জেলা শরীয়তপুরে। তারা কিছুটা সুস্থ হলে আমরা তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেই। এই ঘটনাটা আমার প্রায়ই মনে পড়ে।
হাসান:আপনি তো ২০১২ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। এ পদক প্রাপ্তির অনুভূতি সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : স্বাধীনতার এতো বছর পর স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করেছে- এটা ভাবতেই ভালো লাগে। স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তি আমাকে আনন্দিত করেছে। আমাকে এই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বর্তমানে আপনি কী করছেন? আপনার সময় কীভাবে কাটছে?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : আগেই বলেছি, যুদ্ধকালীন সময়ে আমি মেডিকেলের ছাত্রী ছিলাম। যুদ্ধ শেষ হলে আমি ডাক্তারি পাস করি। চিকিৎসক হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করি। এখনো এ পেশায়ই আছি। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছি। এভাবেই সময় বেশ কেটে যাচ্ছে।
হাসান:বর্তমান সময়ে নারীদের আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : একটা সময় ছিলো নারীদের পদচারণা বাসন-কোসন সাদা আর রান্না-বান্নার ভেতর সীমাবদ্ধ ছিলো। সময়ের সাথে নারীরা পাল্টেছে। তারা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান বিজ্ঞানে, চাকুরি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। আমি বলবো, দশ-পনের বছর আগেরকার সময় থেকে নারীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে জানে।
হাসান:নারীদের এগিয়ে চলার পথে কী প্রতিবন্ধকতা আপনার চোখে পড়ে?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : নারী বৈষম্য বাংলাদেশে আইনগতভাবে দূর হয়েছে। কিন্তু মনের বৈষম্য এখনো দূর হয়নি। নারীর কোনো কীর্তিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিভাদন জানানোর পরিবেশ এখনো ভালোভাবে সৃষ্টি হয়নি। তবে আমার মনে হয়, আগামী ক’ বছরের মধ্যেই এ অবস্থার উত্তরণ ঘটতে পারে।
হাসান:তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের বাংলাদেশ। আর তরুণ তরুণীরাই এ দেশের প্রাণশক্তি। তারা স্বাধীনতার ধারক ও বাহক। তারা স্বাধীনতার চেতনা যেমন সঞ্চার করবে, তেমনি অন্যদের মাঝে সঞ্চারিতও করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলেই সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে।
হাসান:আপনাকে জানাচ্ছি অশেষ শ্রদ্ধা ও সালাম। ধন্যবাদ।
ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী : অপনাকেও ধন্যবাদ।