শনিবার ● ২৭ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না’
‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না’
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।
গণভবনে শনিবার বিকেল সোয়া ৪টায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
রামপাল বিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কিছু উন্নয়নবিরোধী মহল ভিত্তিহীন, কাল্পনিক তথ্য দিচ্ছে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমার প্রশ্ন আন্দোলনে এদের খুঁটির জোর কোথায়? এদের পেছনে অন্তরাল থেকে এতদিন ইন্ধন যোগানোর পর খালেদা জিয়া প্রেস ব্রিফিং করে অপপ্রচারে শামিল হয়েছেন। আমার মনে হয়, বিএনপির এই বিরোধিতার পেছনে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে।’
‘উন্নয়নবিরোধীরা বলছেন রামপাল প্রকল্পে সুন্দরবন ধ্বংস হয়েছে। যেভাবে আমরা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি তাতে আমরা নিশ্চিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।’ যোগ করেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের হাতে সময় কম ছিল। ৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলাম। এই সময়ে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য যে ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। উন্নয়নের ধারা যতটুকু এগিয়ে নিয়েছিলাম তা থমকে যায়।’
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করে হাসিনা বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া ছিল কঠিন কাজ। যেহেতু দেশ আমাদের তাই যে পদেক্ষপ নিয়েছি তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।’
‘বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি বিদ্যুতের জন্য চারদিকে হাহাকার। আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় দেশের মানুষ সুবিধা পেয়েছে। দেশের বেশির ভাগ বিদ্যুকেন্দ্র গ্যাসের ওপর। গ্যাসের মজুদ কমে গেছে। তাই বিকল্প হিসেবে কয়লার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
তাই কয়লা সবচেয়ে নির্ভরেযাগ্য জ্বালানি। যুক্তরাষ্ট্র, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে।
আমরা গ্রাহকদের মধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পদক্ষেপ নিয়েছি। বিএনপির তো কোনো কথা নেই। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন কতটুকু করেছে তা আপনারা হিসাব করে দেখবেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা খাম্বা কোম্পানি করেছি। শুধু খাম্বা বিক্রি করেছে। এর বাইরে আর কিছু দিতে পারেনি। আজ খালেদা জিয়া কথা বলছেন। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।’
সুন্দরবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের স্বীকৃতি হয়েছে কার সময়ে? সুন্দরবন রক্ষা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের কর্মের মাধ্যমে সুন্দরবনের স্বীকৃতি পেয়েছি।
‘আন্তর্জাতিক আইনে আছে গভীর বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না। আমরা তা মেনেছি। আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুন্দরবনের যে অংশ ইউনেস্কো ঘোষণা করেছে তা ৬৫ কিলোমিটার দূরে। এলাকার যে বায়ুপ্রবাহ তা সুন্দরবনের বিপরীত দিকে।’
খালেদা জিয়া তার পুরো বক্তব্যে ‘উদ্ভট, বানোয়াট এবং অসত্য’ উপাত্ত পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
খালেদা জিয়া তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করবে।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ কথা মোটেই সত্য নয়। বরং, এটি নির্মিত হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’
সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষের চুরি করে গাছ কাটার প্রয়োজন আর হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোম্পানি থেকে বছরে ৩০ কোটি টাকা সিএসআর ফান্ডে জমা হবে। তা দিয়ে এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কাজ করা হবে। লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।’
খালেদা জিয়া বলেছেন : ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির উপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে।
শেখ হাসিনা : আসলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জায়গা নেওয়া হয়েছে ৯১৫ একর। এর মধ্যে ৪৬৫ একরে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকবে। বাদবাকি জায়গায় সোলার প্যানেল বসবে এবং সবুজায়ন করা হবে।
খালেদা জিয়া বলেছেন : যে স্থানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৮২ জন। আট হাজারের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। জমি তিন ফসলী।
শেখ হাসিনা : প্রকৃতপক্ষে এলাকাটিতে মানুষের কোনো স্থায়ী বসতি ছিল না। কোনো বসতি উচ্ছেদ করা হয়নি। নিচু, পতিত জমি মাটিভরাট করে উঁচু করা হয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেছেন : রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পশুর নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১৪৪ কিউসেক পানি নেওয়া হবে। ব্যবহারের পর সেই পানি নাকি পরিবশে দূষণ করবে।
শেখ হাসিনা : পশুর নদীর পানিতে লবণ আছে। সেই পানি শোধন করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। ব্যবহৃত পানি শীতল করে পুনরায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। কোনো দূষিত বা গরম পানি পশুর নদীতে ফেলা হবে না। যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হবে তা অত্যন্ত নগণ্য। শুষ্ক মওসুমে পশুর নদীর প্রবাহের মাত্র দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ অর্থাৎ ২ হাজার ভাগের এক ভাগ পানির প্রয়োজন হবে। এই পশুর নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করা হবে। পানি চলাচল বাড়বে। নাব্যতা বৃদ্ধি পেলে মংলা বন্দরে নৌযান চলাচল বৃদ্ধি পাবে। আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
খালেদা জিয়া বলেছেন : ভারতে বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটার মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আইনি বাধা রয়েছে।
শেখ হাসিনা : ভারত একটি বিশাল আয়তনের দেশ। বাংলাদেশের মতো্ ঘনবসতিপূর্ণ দেশের সঙ্গে তুলনা সঠিক নয়।
খালেদা জিয়া বলেছেন : কয়লা পরিবহনের সময় সুন্দরবন এলাকায় শব্দ দূষণ এবং আলো দূষণ হবে।
শেখ হাসিনা : শব্দ ও আলো দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। গভীর সমুদ্র হতে কভার্ড বার্জে কয়লা পরিবহন করা হবে। বার্জে ব্যবহৃত হবে ঢাকনাযুক্ত কম শব্দযুক্ত ইঞ্জিন। ফলে পরিবেশ দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শব্দ দুষণ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকবে। ১৪ কিলোমিটার দূরে শব্দ যাবে না। ২০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
খালেদার জিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উনি কি কখনো ওই এলাকায় গেছেন দেখতে। যে জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে ওটা নালজমি। পশুর নদী ড্রেজিং করেছি। পশুর নদীর ড্রেজিং মাটি দিয়ে তা কুলোনো যায়নি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুই হাজার ভাগের এক ভাগ পানি মাত্র পশুর নদী থেকে নেওয়া হবে। নাব্যতার জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করা হবে। তার ফলে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। তাতে মংলা বন্দরও সুবিধা হবে। পোর্টের আয়ও বৃদ্ধি হবে।’
রামপালে কয়লা পরিবহনে শব্দ দূষণ, আলো দূষণের প্রতি আমরা সজাগ। ঢাকনাযুক্ত, কম শব্দযুক্ত ইঞ্জিনে কয়লা পরিবহন করা হবে। ১৪ কিলোমিটার দূরে শব্দ যাবে না। ইঞ্জিনের শব্দ ১৪ কিলোমিটার দূরে কীভাবে সেটা বিবেচনার ভার আপনাদের ওপর রেখে দিলাম।
খালেদা জিয়া বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে লাখ লাখ মানুষের জীবনজীবিকা ধ্বংস করবে। বিদ্যুৎ পেলে মানুষের জীবন থেমে যায় শুনেছেন কি না জানি না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সৃষ্টি হলে কর্মসংস্থান হবে। মানুষ তো বিদ্যুৎ চায়।’
‘আমরা যে এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করছি তা অবহেলিত। সেই এলাকার মানুষের কাজ কী। সুন্দরবনে চুরি করে গাছ কাটে। কিংবা গাছ কাটতে গিয়ে বাঘের পেটে যায়। রামপাল কেন্দ্র হলে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের মতো কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। সুন্দরবনের গাছ রক্ষা পাবে।’
রামপালে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তা ৯৯.৯৯ শতাংশ ছাই ধরে রাখতে সক্ষম হবে। ছাই সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত হবে। ৯৬ শতাংশ সালফার গ্যাস শোষিত হবে। যা দিয়ে সার তৈরি হবে।
যে চিমনি ব্যবহার করা হবে। যে কার্বণ নিঃসরণ হবে তা ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। মুখে যে ফেসিয়াল মাস্ক ব্যবহার করা হয়। সেটা কার্বন থেকে আসে। তা অনেক কাজে লাগবে। কার্বন মুখের ময়লা পরিষ্কার করে দেয়।
রামপালের বিরুদ্ধে আন্দোলকারীদের প্রতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘বড়পুকুরিয়া ঘুরে আসেন। খনি থেকে যে কয়লা উঠছে সেখানে রেললাইন করা হয়েছে। খোলা অবস্থায় ডাম্প করে রাখা হচ্ছে। সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। জমির কোনো ক্ষতি হয়নি, ফসল ঠিকই হচ্ছে। ধানের চারা রোপন হচ্ছে সেই ছবি তুলেছি, পাকা ধানের ছবিও আছে। সেখানে ভালো আমও হচ্ছে। সবুজ সবুজই আছে।’
পরিবেশ দূষণ হবে বলে সেটা কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন বন্ধ করেননি। কাজেই বোঝা যায় এটা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।
‘বিশ্বের অনেক দেশে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প আছে। বনভূমির মাঝে, শহরের মাঝে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প আছে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে যে কয়েল কোল্ট পাওয়ার প্লান্ট আছে। সেখানে আবার খেলাধূলাও চলছে।
ভিয়েতনামে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র এরকম কেন্দ্র আছে। জাপানের ইয়াকোহামায় আবাসিক এলাকার ঠিক পাশে এই কেন্দ্র আছে। জার্মানি জলেং বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশ্বসাহিত্য সংরক্ষিত এলাকার মাত্র ৫০০ মিটার দূরে।
রামপালের পাশাপাশি আনোয়ারা নিয়ে কথা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ প্লান্ট নিয়েও হয়ত কথা বলা শুরু হবে। কথা শুনে সব বন্ধ করে দিলে বিদ্যুৎ পাবেন না। কেউ করে দেবে সেটাও আশা করেন না। আপনারা বললে সব বন্ধ করে দেব। হারিকেন বা বাতি জ্বালিয়ে চলবেন।
আন্দোলনকারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোড মার্চ করা, গাড়ি ঘোড়া ভাড়া, ফুয়েল কোথা থেকে পাচ্ছেন। অর্থকড়ি কোথা থেকে পাচ্ছেন? টাকা-পয়সা কোথা থেকে পাচ্ছেন সেটা আমার প্রশ্ন। তাদের উদ্দেশ্য কী সেটাই আমার বড় একটা প্রশ্ন।
সূত্র: পরিবর্তন