রবিবার ● ১৪ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » লালমোহন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জমি বেহাত হচ্ছেই, চলছে পুকুর দখলের মহোৎসব !
লালমোহন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জমি বেহাত হচ্ছেই, চলছে পুকুর দখলের মহোৎসব !
বিশেষ প্রতিনিধি: ভোলার লালমোহন পৌরসভার শতবর্ষী লালমোহন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জমি বেহাত হচ্ছেই। দুটি বড় পুকুরসহ বিদ্যালয়টির অন্তত ৪০ একর জমি ছিল। এখন আছে মাত্র চার একর জমি। আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলছে পুকুর দখলের মহোৎসব।
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, সদস্য ও শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ের উন্নয়নের নাম করে এসব জমি ভাড়া দিয়ে আসছেন। তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রাণ গোপাল দে বলেন, পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি সম্প্রতি জাতীয়করণ হয়েছে। তিনি দুটি পুকুরসহ বিদ্যালয়ের জমি দখলের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সব কাগজপত্র নিয়ে ভোলায় আসতে বলেছেন। বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দেখবেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের চারদিকে দখল করে পাকা স্থাপনা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতঘর গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে কয়েকটি পাকা ও আধা পাকা ঘর তোলা হচ্ছে। অনেক স্থানে সীমানা খুঁটি পুঁতে প্লট ভাগ করা আছে। অনেকে সীমানাপ্রাচীর দিয়েছেন। বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে একটি পুকুর আছে। পুকুরটিতে তিনটি টিনের বসতঘর উঠেছে। পশ্চিম-উত্তরে আরেকটি পুকুর রয়েছে। এর চারপাশে বাঁশ পুঁতে কাঠ বিছিয়ে দোকানপাট তোলা হচ্ছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক প্লট ও নির্মাণাধীন ভবনের মালিক শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি, শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ কমপক্ষে ৫০ জন প্রথম আলোকে বলেছেন, পৌরসভার ২, ৩, ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিদ্যালয়ের নামে ৪০ একর জমি ছিল। ২০১১ সালেও বিদ্যালয়ের জমি ছিল প্রায় ১৫ একর। কিন্তু এখন বিদ্যালয় ভবন ও মাঠ মিলে মাত্র চার একরের মতো জমি বিদ্যালয়ের দখলে আছে। বাকি দুটি পুকুরসহ প্রায় ১০ একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রায় ১ একর ৩৩ শতাংশ জায়গায় ব্যবস্থাপনা কমিটি ২০১১-১২ সালে বিপণিবিতান নির্মাণ করে। পরে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। উত্তর-পশ্চিম পাশের পুকুরে দোকানপাট নির্মাণ করা হচ্ছে। দক্ষিণের পুকুর, খেলার মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, মহিলা কলেজের পেছনে, উত্তর বাজার, ফরাজগঞ্জের জমিসহ প্রায় ৯ একর জমি বসতঘরের জন্য ৯৯ বছর মেয়াদে ভাড়া দেয় কমিটি। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ একর ৩৩ শতাংশ জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। চুক্তিপত্রের বাইরে ভাড়াটেদের কাছ থেকে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছে কমিটি।
২০১২ সালে দোকানপাট নির্মাণের জন্য একটি পুকুর ভরাটের সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মঞ্জুর মোর্শেদ একই বছরের ২ নভেম্বর উচ্চ আদালতে রিট করেন। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি রিট শুনানিতে পুকুর ভরাটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। কিন্তু ৬ আগস্ট রাতে ওই পুকুর আবার দখল করে ঘর তৈরির কাজ শুরু করেন ৪১ জন ভাড়াটে।
জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সদস্যসচিব মো. হেলাল উদ্দিন পঞ্চায়েত বলেন, তিনি ২০১১ সালের শেষের দিকে এ বিদ্যালয়ে যোগ দেন। তখন বিদ্যালয়ের মোট জমির পরিমাণ ছিল ১৪ একর ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে কিছু জমিতে ৩১০ জন ভাড়াটেকে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা হারে প্রতি প্লট ভাড়া দেওয়া হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, ভাড়াটেরা ওই জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবহার করবেন। ভাড়াটেদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। কতটুকু জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, তা তিনি জানেন না বলে মন্তব্য করেন।
ভোলা-৩ আসনের সাবেক সাংসদ ও বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন আহমেদসহ কমপক্ষে ২০ জন প্রাক্তন ছাত্র বলেন, ‘আমরা শুনেছি বিদ্যালয়ের ৪০-৪৫ একর জমি ছিল। ওই জমি বিভিন্ন সময়ে বেহাত হয়েছে। সরকারের উচিত তদন্ত করে বিদ্যালয়ের সব জমি উদ্ধার করা। যাঁরা বিদ্যালয়ের জমি বিক্রি করেছেন তাঁদের আইনের আওতায় আনা উচিত।’
জেলা প্রশাসক মোহা. সেলিম উদ্দিন বলেন, বিদ্যালয়ের পুকুর দখলের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তবে দখলবাজরা রাতে কাজ চলমান রেখেছে কি না, তা তাঁর জানা নেই।
উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. শামসুল আরিফ বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা কমিটি যদি বিদ্যালয়ের জমি দীর্ঘ মেয়াদে ভাড়া কিংবা বিক্রি করে থাকে, তা আইনে টিকবে না। আমরা সরকারি জমি উদ্ধার করবই।’
সূত্র: প্রথম আলো