শনিবার ● ১৬ জুন ২০১৮
প্রথম পাতা » জাতীয় » ঈদ এলেই দীর্ঘশ্বাসটা যেখানে চওড়া হয়
ঈদ এলেই দীর্ঘশ্বাসটা যেখানে চওড়া হয়
ডেস্ক: মা-বাবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় তার সন্তানেরা। ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির সব মা-বাবার কাছে একই। সন্তানকে আগলে রাখতে তারা কি না করেন! ঈদে নিজের জন্য কিছু না করলেও সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে হাত পাততেও দ্বিধা করেন না। সেই বাবা-মা এক সময় হয়ে পড়েন অপাংক্তেয়। তাদের স্থান আর সন্তানদের ‘সুখের স্বর্গে’ হয় না। তবে এসব সন্তানেরা ‘অকৃতজ্ঞ’ নন। অর্থের বিনিময়ে মা-বাবার যত্নের ভার তুলে দেন দীর্ঘশ্বাসের এক বসতবাড়িতে, যেটিকে ভদ্রসমাজ নাম দিয়েছে বৃদ্ধাশ্রম।
বৃদ্ধাশ্রম অর্থ বৃদ্ধদের আশ্রস্থল। সহায়-সম্বলহীন বয়োবৃদ্ধরা এটিকে জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেন। কিন্তু, এখন সম্ভবত দিন বদলেছে, অনেক সম্পদশালীও বাধ্য হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো এখানে কাটাচ্ছেন। শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা, বাংলাদেশে দিনকে দিন বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে।
ছেলের উন্নত ক্যারিয়ার। কর্মব্যস্ত দিন। বৃদ্ধ বাবা-মাকে সময় দিতে পারেন না। স্ত্রীও হয়তো কর্মজীবী নতুবা চান না এমন উটকো ঝামেলা। ফলে অনেক পরিবারে নিঃসঙ্গ জীবন কাটান বয়োবৃদ্ধরা। এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চ শিক্ষিত সন্তানেরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার পথ বেছে নিচ্ছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একাকী জীবনযাপন করতে হচ্ছে পরিবারে এক সময়ের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে।
শনিবার ঈদুল ফিতরের দিন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ নামের বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের রুদ্ধশ্বাস দেখা গেছে।
বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমটিতে ৪৬ জন বসবাস করছেন। এদের মধ্যে ২৪ জন নারী, বাকি ২২ জন পুরুষ। বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
বৃদ্ধাশ্রমটি ১৯৬৮ সাল থেকে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মহলের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে আসছে।
শনিবার ঈদুল ফিতরের দিনে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের জন্য সকালে বিভিন্ন সেমাই ও পোলাও ছিল। দুপুরে ভাতের সঙ্গে মুরগীর মাংস, গরুর মাংস ও চাইনিচ সবজি। আর রাতের মেন্যুতে রয়েছে ভাত, মুরগীর মাংস ও ডাল। অবশ্য বিকেলে দেয়া হয় নুডুলস ও ফিরনি।
ঈদের দিন ছাড়াও প্রায় এমন খাবার পরিবেশন করে থাকে কর্তৃপক্ষ। এসব খাবারের বাইরেও বাসিন্দাদের স্বজনেরা মাঝেমধ্যে খাবার দিয়ে যান।
প্রতিষ্ঠানটিতে ২০ বছর ধরে কর্মরত আব্দুস ছাত্তার। তিনি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমের অধিকাংশ বাসিন্দার যত্ন নেয়ার মতো পরিবারে কেউ নেই। সন্তানেরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। সারাদিন বাসায় কেউ থাকেন না। তাই এখানে রেখে যান।’
আব্দুস সাত্তার জানান, দীর্ঘদিন অবস্থান করা এসব বয়োঃবৃদ্ধদের অনেকে চলাফেরার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের জন্য স্বজনেরা একজন কাজের লোক রেখে গেছেন।
তিনি আরও জানান, বৃদ্ধাশ্রমেই অসুস্থদের চিকিৎসা করা হয়। বেশি অসুস্থ হলে স্বজনেরা কাউকে কাউকে বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা শেষে আবার রেখে যান।
কথা হয় এ নিবাসের বাসিন্দা সাবেক প্রকৌশলী আবু তৈয়বের সঙ্গে, তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। ৫ বছর ধরে আছেন বৃদ্ধাশ্রমে।
আবু তৈয়ব জীবনের লম্বা সময় সরকারের গণপূর্ত বিভাগে নিয়োজিত ছিলেন। সরকারি অনেক ভবন নির্মাণের সাক্ষী এই প্রবীণ নাগরিক।
প্রশ্ন করা হলে তিনি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, শরীর বেশি ভাল নেই। নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে, চিকিৎসা করাচ্ছি। এখানে ছাড়াও বাইরে চিকিৎসা করাই।
পত্রিকা পড়ে ও টেলিভিশন দেখে দিন কাটছে আবু তৈয়বের। স্ত্রী বেঁচে আছেন কিনা জানতে চাইলে, সাভারে থাকেন বলে জানান। কিন্তু, কার কাছে, কি করেন, সে বিষয়ে আর কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি তিনি।
আবু তৈয়বের ভাষ্যে, তিন মেয়ে, এক ছেলে তার। সন্তানেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। দুই জামাই প্রকৌশলী। আরেক জামাই ব্যবসায়ী। ছেলেটা বিএসসি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। স্বজনেরা মাঝেমধ্যে দেখতে আসে।
কথা প্রসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম সবাই একসঙ্গে থাকব। ওদের যোগ্য মানুষ করতে সব বৃদ্ধাশ্রমে তিন বছর আছেন মিরা চৌধুরী। জন্ম কলকাতার জাকারিয়াস্ট্রিকে হলেও পড়ালেখা করেছেন বাংলাদেশে। খুলনা মহিলা কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। তার একমাত্র ছেলে কানাডায় পড়াশুনা করে সেখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস করছে।
এই নারীর কথাতে উঠে এলো, তার কোনো খোঁজ-খবর নেন না ছেলে। তবে মায়ের যাতে কোনো কিছুর কমতি না হয়, সেজন্য মাসে মাসে বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা পাঠান।
পার করে মেরি মাধুরী পূর্ণিমার আশ্রয় এখন আগারগাঁওয়ের বৃদ্ধাশ্রম। ইতোমধ্যে এখানে কেটে গেছে চার বছর। দুই ছেলে ভিন্ন ভিন্ন দুটি সিমেন্ট কোম্পানির বড় কর্তা। দুই মেয়ের বড়টা বেসরকারি ডাচবাংলা ব্যাংকে চাকরি করেন, অনেক বেতন পান। ছোট মেয়ে গৃহিনী।
ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে না থেকে বৃদ্ধাশ্রমে কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সন্তানেরা চাই না, তাদের সঙ্গে থাকি। ওরা বলে, বৃদ্ধাশ্রমেই আমি নাকি ভালো থাকব, তাই ৪ বছর ধরে ‘ভালো’ আছি।’
বয়সের ভারে চলাফেরা করতে কষ্ট হয় মেরী মাধুরীর। তারপরও মেনে নিয়েছেন তিনি। ৭ বছর আগে স্বামী মারা যান, এরপরই কপাটে জোটে সন্তানদের অবহেলা।
মেরীর বাপের বাড়ি মাদারীপুর। স্বামীর বাড়ি ফরিদপুর। বৃদ্ধাশ্রমে তার ছেলে মাঝেমধ্যে এসে কিছু খাবার দিয়ে যায় বলেও জানান তিনি। সালে মরহুম ডা. একেএম আব্দুল ওয়াহেদ এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত পরিচালক মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘প্রত্যেক বৃদ্ধের কাছ থেকে প্রতি মাসে সিট ভাড়া বাবদ দুই হাজার এবং খাওয়া বাবদ নেয়া হয় দুই হাজার ৮০০ টাকা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সহযোগিতায় পরিচালিত হয় এ বৃদ্ধাশ্রম।