

মঙ্গলবার ● ২৪ এপ্রিল ২০১৮
প্রথম পাতা » পাঠকের মতামত » আফগান ফিলিস্তিন কাশ্মীর: যেখানে মিশে গেছে রক্ত-মাটি
আফগান ফিলিস্তিন কাশ্মীর: যেখানে মিশে গেছে রক্ত-মাটি
ডেস্ক: গেল ৩০ শে মার্চ ফিলিস্তিনের জাতীয় ভূমি দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ৬ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী শহীদ হন। তাদের স্মরণে ফিলিস্তিনিরা এ দিবস পালন করে নিজেদের ভূমি প্রতিরক্ষার প্রতিজ্ঞা করে এবং এ দিবসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদেরও বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।
তবে ২০১৮ সালের ভূমি দিবস এ থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। এবারের ভূমি দিবসে ফিলিস্তিনিরা ঘোষণা করেছিল, তারা নিজেদের সেই সকল ভূমি অভিমুখে শান্তিপূর্ণভাবে মার্চ করবে, যেগুলো অবৈধ ইহুদি দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল ১৯৪৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জবরদখল করে রেখেছে। এই শান্তিপূর্ণ মার্চকে ‘গ্রেট রিটার্ন মার্চ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়- যাতে ৩০ শে মার্চ হাজার হাজার ফিলিস্তিনি অংশ নেন এবং মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য নিজেদের ‘ঘর’ অভিমুখে যাত্রা করেন।
দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল- যে বিগত সত্তর বছর যাবত ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমিতে কেবল নিজের অবৈধ দখলদারিত্বই প্রতিষ্ঠা করেনি বরং ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মজলুম জনতার ওপর যখন ইচ্ছা গণহত্যা চালানোকে একটি মামুলি বিষয় বানিয়ে নিয়েছে।
দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল ফিলিস্তিনের এবারের ভূমি দিবসে পূর্ব ঘোষিত গ্রেট রিটার্ন মার্চের প্রতি ভীত ছিল। সে কারণে বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করে ফিলিস্তিনিদের গ্রেট রিটার্ন মার্চ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে।
তবে এই সিদ্ধান্ত যদি কোনো রাজনৈতিক দলের হতো, তাহলে হয়তো ইসরাইল ও আরব নেতাদের সাথে কোনো সওদা করে নিত- ফলে ইসরাইল ও আরব নেতৃবর্গের দ্বিমুখী চাপে গ্রেট রিটার্ন মার্চের মুলতবিও ঘোষিত হতো। কিন্তু নিজেদের হৃত অধিকার জবরদখলকারীদের থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য এই ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনতার। কোনো চাপ বা ধ্বংসলীলার পরোয়া না করে তারা ৩০ শে মার্চ অধিকৃত ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
দখলদার ইসরাইল আদর্শচ্যুত আরব রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে তাদেরকে মার্চ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে বিশেষ প্রশিক্ষিত স্নাইপার ও সশস্ত্রবাহিনীকে প্রস্তুত করে রাখে- যেন তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে হলেও ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ গ্রেট রিটার্ন মার্চ বাঞ্চাল করে দেয়।
এতদসত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা ইজ্জত ও মর্যাদার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ৩০ শে মার্চ তারা অবৈধ দখলদারিত্বের অধীনে থাকা মাতৃভূমি ফিলিস্তিন অভিমুখে বেরিয়ে পড়েন। তখন অগণতান্ত্রিক ইহুদিবাদী ইসরাইল বরাবরের মতো নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিশেষ প্রশিক্ষিত স্নাইপারদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিশানা বানায়, ড্রোন ও বিমান থেকেও তাদের শান্তিপূর্ণ মার্চে হামলা চালায়। ফলে ১৭ জন শহীদ হন ও কমপক্ষে ১৫০০ ফিলিস্তিনি আহত হন। এরপর থেকে অব্যাহত বিক্ষোভ ও ইসরাইলের আরও উপর্যুপরি হামলায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত মোট ৩৪ শহীদ হয়েছেন এবং হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে।
দখলদার ইসরাইলের এমন ন্যাক্কারজনক সহিংসতায় সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠে, কিন্তু আফসোসের বিষয়- তা কেবল জনগণের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীর জন্য এটা তেমন কোনো দুর্ঘটনাই না। মুসলিম বিশ্বের শাসকদের কথা বলা হলে বা আরও বিশেষভাবে যদি আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজা-বাদশাহদের কথা বলা হয়, তাহলেও বোঝার উপায় নেই যে এই সহিংস ঘটনার কোনো প্রভাব তাদের ওপর পড়েছে। তাদের থেকে না এসেছে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল নিন্দা, আর না কোনো প্রতিবাদ। কিছু বেসরকারি সংগঠনের অধীনে গুটিকয় বিক্ষোভ মিছিল হলেও শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক নীরবতা খুবই লজ্জাজনক। কোথায় চলে গেল তাদের ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ! দ্বীন-ধর্ম যদি খেয়েই থাকে, তবু তাদের আরব্য জাতিগত মর্যাদাবোধ কোথায় নেমে গেল!
এর আগেও যদি আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জেরুজালেমকে দখলদার ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করা ও সেখানে আমেরিকার দূতাবাস স্থানান্তর করার প্রসঙ্গে আসি, তখনও মুসলিম বিশ্বের শাসকেরা কেবল বিবৃতি সর্বস্ব নিন্দা প্রকাশ ছাড়া কার্যকর কিছুই করেননি।
অপরদিকে, এই বিয়োগান্তক ঘটনার পরপরই ভারতও একইভাবে কাশ্মীরে হত্যা ও ব্যাপক জেলবন্দী করে। এখানেও প্রায় সতেরজন নিরাপরাধ কাশ্মীরিকে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। এ ঘটনায় বিশ্বের কোনো দেশকে কোনো প্রকার নিন্দা জানাতে শোনা যায়নি। একমাত্র কাশ্মীরের সাথে স্বার্থ জড়িত বলেই পাকিস্তানের প্রতিবাদ-নিন্দা অব্যাহত আছে।
এই জখমগুলো তাজা থাকতেই আফগানিস্তানের একটি হাফেজি মাদরাসায় তালেবান থাকার বাহানা বানিয়ে আমেরিকার হামলায় এখন পর্যন্ত অনেক হাফেজ, অর্ধ হাফেজ পুণ্যাত্মা পুস্পতুল্য শিশু, তাদের অভিভাবক ও বেসামরিকসহ প্রায় ১৫০ জন শহীদ হয়েছেন।
যদি গভীর দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে এই সকল সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড গত ৩০ মার্চ ফিলিস্তিন থেকে শুরু হয়ে কাশ্মীর; অতঃপর এখন আফগানিস্তান গিয়ে পৌঁছেছে- এই সব কিছুর পেছনে যদি কারো আশীর্বাদ থাকে, তাহলে সে ওই বৃদ্ধ শয়তান আমেরিকারই।
আমেরিকার শয়তানি যদি দেখতে হয় তাহলে সব সময় জাতিসংঘে তার সবচে’ সুন্দর দৃষ্টান্ত সামনে আসে, যখন অবৈধ দখলদার ইসরাইলের স্বার্থবিরোধী কোনো কিছু উত্থাপন করা হয়, তখন ইসরাইলের চেয়ে বেশি অসন্তুষ্টি আমেরিকাই প্রকাশ করে। এমনকি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য আমেরিকা যে সাহায্য দিত তাও সম্প্রতি বন্ধ করে দিয়েছে।
বর্তমানে আবারও একবার যদিও কাশ্মীরে ভারতীয় সহিংসতার কোনো নিন্দা সামনে আসেনি, তবু ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসনকে শিরোনাম করে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ইসরাইলের প্রতি তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে ও একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। যারপর আমেরিকা প্রস্তাবটিকে একেবারে খোলামেলা শব্দে কেবল প্রত্যাখ্যান করেই শেষ করেনি বরং ফিলিস্তিনিদের হত্যার অধিকার ইসরাইলের আছে বলে মন্তব্য করেছে।
প্রায় একই রকম বক্তব্য কিছু দিন আগে আমেরিকা সফরকালে সৌদি যুবরাজ থেকে মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এসেছে। যাতে সৌদি আরব দখলদার জাতিরাষ্ট্র ইসরাইলকে এক প্রকার সমর্থন দিয়েছে।
মোট কথা এই যে, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ শাসকই আমেরিকার পদলেহনে ব্যস্ত। এ সকল শাসকদের কাছে সামগ্রিক জাতি-স্বার্থের চেয়ে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে বিশ্বে ঘটমান কোনো জুলুম-অত্যাচার ও আমেরিকা-ইসরাইলের কোনো সন্ত্রাস এ সকল শাসকেরা দেখতে পায় না।
আজ কাশ্মীর হোক বা ফিলিস্তিন, আফগান হোক বা ইয়েমেন- প্রায় সব জায়গাতেই মার্কিন সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুসলমান হত্যায় নিয়োজিত। কোথাও আমেরিকা আইএস সৃষ্টি করে- তো কোথাও ইয়েমেনে সৌদিকে দিয়ে হত্যা করায়। আর কোথাও সে দখলদার ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষকতা করে ফিলিস্তিনিদের হত্যার বৈধতা দেয়, পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তা ধ্বংস করে।
এখন সময়ের জরুরি দাবি হলো, মুসলিম উম্মাহ নিজেদের কাতারে এক হয়ে সবার জাতীয় শত্রু ইসরাইল-আমেরিকাকে যেন চিনে নেয়। আর আমেরিকা-ইসরাইল কেবল ইসলাম ও মুসলমানেরই শত্রু নয়- বরং সমগ্র মানবতার শত্রু।
লেখক: তরুণ আলেম, মিডিয়া কর্মী