শুক্রবার ● ৭ জুলাই ২০১৭
প্রথম পাতা » জাতীয় » শনিবার ৮ জুলাই নাসরিন-১ ট্রাজিডি দিবস: স্বজন হারানোর স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা
শনিবার ৮ জুলাই নাসরিন-১ ট্রাজিডি দিবস: স্বজন হারানোর স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা
শিমুল চৌধুরী: শনিবার ৮ জুলাই নাসরিন-১ ট্রাজিডি দিবস। ভোলার লালমোহন টু ঢাকা রুটে চলাচলকারী এমভি নাসরিন-১ লঞ্চডুবির ঘটনায় স্বজনদের হারানোর স্মৃতি বর্ণনা করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন হতাহতদের পরিবারের সদস্যরা।
এই উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ভোলা আইনজীবী সমিতির ভবনের সম্মেলন কক্ষে “লঞ্চ ডুবিতে আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইনগত বাধ্যবাধকতা” শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তারা ১৪ বছর আগের স্মৃতি তুলে ধরেন। মতবিনিময় সভায় এমভি নাসরিন ট্রাজিডিতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ২৬ জনকে হারোনোর স্মৃতির বর্ননা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের মহেষখালী গ্রামের মোঃ মোস্তফা। তিনি জানান, ওই দিন ওই লঞ্চে চড়ে ঢাকা থেকে বরযাত্রী বেশে আসছিলেন তারা। প্রায় একইভাবে ছেলে, মামা ও ভাতিজাকে হারানোর স্মৃতি তুলে ধরেন একই উপজেলার মাহমুদ। দুই ছেলে মোসলেহ উদ্দিন ও জুয়েলকে হারানোর স্মৃতি তুলে ধরেন হতভাগ্য বাবা আব্দুল মতিন। স্বামী হারানোর স্মৃতি বর্ননা করেন স্ত্রী সামছুন্নাহার। স্বজন হারানোর কান্নায় এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ মতবিনিময় সভা। এমভি নাসরিন-১ লঞ্চডুবির ঘটনায় দায়ের করা ক্ষতিপূরণ মামলায় উচ্চ আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) নেতৃবৃন্দ ও লঞ্চ দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্বজনরা।
এমভি নাসরিন ট্রাজিডির ১৪ বছর পূর্ণ হওয়াকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) নেতৃবৃন্দ জানান, ২০০৩ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এমভি নাসরিন-১ নৌযানটি প্রায় ৮০০ যাত্রী এবং অতিরিক্ত পণ্য ও মালামাল নিয়ে ঢাকা সদরঘাট থেকে ভোলার লালমোহনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। লঞ্চটি পথিমধ্যে চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় পৌঁছুলে রাত প্রায় ১১টার দিকে যাত্রী ও মালামালসহ নদীতে ডুবে যায়। ওই সময়ে ১১০ যাত্রী মারা যান এবং বহু যাত্রী আহত হন। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ওই বছরই লঞ্চডুবিতে ক্ষতিগ্রস্থ ৪০০ পরিবারের তালিকা প্রকাশ করেন। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন অতিরিক্ত মালামাল বহনকে চিহিৃত করা হয়। নেতৃবৃন্দ বলেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতাসহ প্রচলিত আইনের ব্যতয় ঘটার কারনে যথাযথ ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০০৪ সালে ঢাকার তৃতীয় জেলা জজ আদালতে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি পরিবারের পক্ষে ব্লাস্ট একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১২১ জন ব্যক্তি বাদী হন। বিবাদি করা হয় সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর, লঞ্চ মালিক, সারেং এবং সমিতিসহ মোট ২১ জন/প্রতিষ্ঠানকে। দুর্ঘটনার দীর্ঘ ১২ বছর পর বিগত ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী নিম্ম আদালত ওই মামলার রায় ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্থদের ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন। রায়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে, নিখোঁজ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে ও আহতদের ১ লাখ টাকা করে প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএসহ বিবাদিপক্ষ বিগত ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করে। ২০১৭ সালের ৫ জুন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিম ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ রুলটি খারিজ করে ব্লাস্ট কর্তৃক দায়েরকৃত বহুল আলোচিত লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ হওয়া সংক্রান্ত মামলা নিম্ম আদালতের রায় বহাল রাখেন। উচ্চ আদালতের এ নির্দেশের মাধ্যমে নিম্ম আদালতে দায়েরকৃত মামলায় ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান সংক্রান্ত প্রদত্ত আদেশ কার্যকর করে সকল ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ প্রদানে আর কোন বাঁধা থাকলোনা।
তারা আরো বলেন, লঞ্চ দুর্ঘটনায় মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের রায় এই প্রথম। এটা একটি বিরল ও নজিরবিহীন ঘটনা। নিম্ম আদালতের এ রায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলেও মন্তব্য করেন তারা।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরণের কোন ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনা যেন না ঘটে এবং লঞ্চে যেন অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই না হয় সেজন্যই এ মামলা দায়ের করার উদ্দেশ্য। এর ফলে আমরা অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবো। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট মমতাজ বেগম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মমিন টুলু, জেলা ও দায়রা জজ ফেরদৌস আহমেদ। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট ওবায়েদুর রহমান শাজাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তৃতা করেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এনামুল করিম, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আক্তারুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আব্দুল হালিম, ব্লাস্টের পরিচালক এসএম রেজাউল করিম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মশিউর রহমান, ব্লাস্ট বরিশাল ইউনিটের সমন্বয়কারী এডভোকেট খলিলুর রহমান, ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট জীবনানন্দ জয়ন্ত, ভোলা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুরনবী, এডভোকেট নজরুল হক অনু, এডভোকেট মোঃ শাহজাহান, এডভোকেট রাজেশ্বম দত্ত প্রমূখ।
-এফএইচ