সোমবার ● ১ জুন ২০১৫
প্রথম পাতা » জেলার খবর » দারিদ্রতা রুখতে পারেনি তজুমদ্দিনের ছয় মেধাবীর সাফল্য
দারিদ্রতা রুখতে পারেনি তজুমদ্দিনের ছয় মেধাবীর সাফল্য
শরীফ আল-আমীন, তজুমদ্দিন প্রতিনিধি :: ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার ছয় দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীর সাফল্য এলাকাবাসীর মুখ উজ্জল করেছে। দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ায় তাদের নিয়ে শুরু হয়েছে পরিবারের স্বপ্ন দেখা। মেধাবী এ সকল ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যেকেই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। এদের কেউ কৃষক পরিবার, জেলে, দিন মজুর ও ফুটপাতের চা বিক্রেতার কাজ করে। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে শিক্ষকরা তাদেরকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন বিনা টাকায়। শিক্ষক ও আত্মীয়ের টাকায় ফরম ফিলাপ হয়েছে কারো কারো।
উপজেলায় এবারের মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় ৩০ কৃতি শিক্ষার্থীর মধ্যে এই ছয় অদম্য মেধাবীর প্রধান বাঁধা অতি-দারিদ্রতা। এমন সাফল্যের পরও তারা শঙ্কিত স্বপ্ন ভঙ্গের। মেধাবী এসব শিক্ষার্থীদের আকুতি সরকারী বা বে-সরকারী সহযোগীতার মাধ্যমে তাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার।
ফুটপাতের দোকানে কাজ করেও সাগর দত্তের সাফল্য:
বাবা বিপুল দত্তের সাথে প্রতিদিন উপজেলা সদরে ফুটপাতের একটি দোকানে বিভিন্ন খাবার ও চা বিক্রির পাশাপাশি চলতো সাগর দত্তের পড়া লেখা। পড়া লেখার প্রতি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পিতার অভাব অনটনের কারণে ফরম ফিলাপ করতে না পেরে এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরে স্কুলের সহকারী শিক্ষক পরিমল চন্দ্র দত্তের দেয়া পনের শত টাকায় পরীক্ষার ফরম পূরণ হলে আবার শুরু হয় পথ চলা। এ ছাড়াও শিক্ষকদের কাছে বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পেয়ে সাফল্য হাত ছাড়া করেনি সাগর দত্ত। চাঁদপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ হতে জিপিএ-৫ পাওয়া এ মেধাবী সকলের সহযোগীতায় বাবা মা’র স্বপ্ন পূরণ করতে বিসিএস কর্মকর্তা হতে চায়।
ধার করা টাকায় ফরম ফিলাপ হয় জসিম উদ্দিন সৌরভের :
উপজেলার মোল্লা কান্দি গ্রামের মোঃ হাফেজ অন্যের মাছের আড়তে শ্রমিকের কাজ করে সামান্য টাকা দিয়ে চলতো সৌরভ ও কামাল দুই সহোদরের লেখা পড়া। হাতে টাকা না থাকায় এক নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে ধার করে দুই ভাইয়ের ফরম ফিলাপ করেন বড় ভাই হাফেজ। দরিদ্র শিক্ষার্থী জেনে শিক্ষকরাও প্রাইভেট পড়িয়েছেন বিনা টাকায়। শিক্ষক ও পরিবারের এ ত্যাগের প্রতিদানে সৌরভ সাফল্যের সাথে চাঁদপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগ হতে জিপিএ-৫ পেয়েছে । অপর সহোদর কামাল পেয়েছে জিপিএ-৪.৭২। সৌরভ ভাইয়ের দুঃখ দূর করতে ভবিষ্যতে জেলা প্রশাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
জিল্লুর রহমান ভবিষ্যতে ফরেন ক্যাডার হতে চায়:
উপজেলার দেওয়ানপুর গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক মোঃ মহসিন মিয়ার অভাব অনটনের সংসারে দিনপার করাই কষ্টকর। সংসার খরচ কমিয়ে বাঁচানো টাকা দিয়ে পরীক্ষার ফরম পূরণ করেন ছোট ছেলে জিল্লুরের। সামান্য কৃষি জমির আয় থেকেই এক মেয়ে ও এক ছেলের ঢাকায় পড়ার খরচ যোগাতে হয় পরিবারের। এরসাথে জিল্লুরের পড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয় দরিদ্র কৃষক মহসিন মিয়ার। তাই স্কুলের শিক্ষকরা বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়ান জিল্লুরকে। সাফল্যকে দৃঢ়তার সাথে জয় করতে ভুল করেনি চাঁদপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ হতে জিপিএ-৫ পাওয়া এ মেধাবী। কৃতিত্বের জন্য বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞ জিল্লুর। সে ভবিষ্যতে ফরেন ক্যাডার হয়ে বাবার স্বপ্ন পুরণ করতে চায়।
দৃঢ়তায় ফাহাদ বিন হাবিবের সফলতা:
উপজেলার দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। নিজের সামান্য কৃষি জমির আয় থেকেই ৩ সন্তানের পড়া শুনার খরচ জোগাতে চেষ্টার কমতি নেই। অল্প আয়ের টাকা দিয়েই ঢাকায় বড় মেয়েকে আর্কিটেক্সার ও ছেলেকে ভোলায় কৃষি ডিপ্লোমা পড়ান। টাকার অভাবে নিয়মিত প্রাইভেটও পড়াতে পারেনি ছোট ছেলে ফাহাদকে। গত বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ না পাওয়ায় এ বছর আবারও শুরু হয় তার সংগ্রাম। পিতার অনুপ্রেরণা ও নিজের দৃঢ়তায় চাঁদপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ হতে ফাহাদ জিপিএ-৫ পেয়ে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মুখ উজ্জল করেছেন। পরিবারের স্বপ্ন পুরণের জন্য ফাহাদ ভবিষ্যতে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
স্বরুপ দত্তের স্বপ্নে বাধা শুধু দারিদ্রতা :
অন্যের জমি বর্গা চাষ করেই পরিবারের একমাত্র আয় উপার্জন হত দরিদ্র কৃষক লক্ষ্মন দত্তের। অভাবের সংসারে হিমশিম খেতে হয়েছে ছেলে স্বরুপ দত্তের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা জোগাতে। টাকার অভাবে নিয়মিত প্রাইভেটও পড়া হয়নি স্বরুপের। পিতার অসামান্য চেষ্টা আর নিজের প্রত্যয়ে এবার এসএসসি পীক্ষায় পঞ্চপল¬ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে স্বরুপ দত্ত মুখ উজ্জল করেছে পরিবারের। স্বপ্ন তার প্রকৌশলী হয়ে বাবা মায়ের দুঃখ দুর করবে। কিন্তু মুহুর্তেই তার এ স্বপ্ন যেন ছোট আসছে পারবারের অস্বচ্ছলতার কারনে। তারপরও ছেলের পড়ালেখার জন্য সম্ভব সব কিছু করতে প্রস্তুত লক্ষন দত্ত।
একক প্রচেষ্টায় শিরিনা আক্তারের অভাবনীয় সাফল্য :
উপজেলা শশীগঞ্জ গ্রামের দরিদ্র জেলে পরিবারের মেয়ে শিরিনা আক্তার একক চেষ্টায় নিজের সাফল্যতার মাধ্যমে জিপিএ-৫ পেয়েছে। পরিবারের আর কোন শিক্ষিত লোক না থাকলেও তার সাফল্যে খুশি নিজ বিদ্যালয় চাঁদপুর ফজিলতুননেছা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাসহ পরিবার। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া এ মেধাবী ছাত্রী পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে বার বার লেখা পড়ায় বিঘœ ঘটেছে। তার পিতা দরিদ্র জেলে আঃ খালেক আবার ধার কর্জ করেই চালিয়ে যেতেন মেয়ের সব খরচ। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতার হাত বাড়িয়েছেন দরিদ্র শিক্ষার্থী হওয়ায়। ভবিষ্যতে সকলের সহযোগীতায় সে ডাক্তার হয়ে উপকূলিয় এলাকার দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আগ্রহ তার।