বুধবার ● ১ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » ভোলায় ৫ বছরে নিহত ৬ শতাধিক জেলে,উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে সংসার চলে অনাহারে অর্ধাহারে !
ভোলায় ৫ বছরে নিহত ৬ শতাধিক জেলে,উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে সংসার চলে অনাহারে অর্ধাহারে !
এসইউ.সোহেব/আব্দুল হান্নান: ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৫ বছরে জলদস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিহত হয়েছে ৬ শতাধিক জেলে। এছাড়াও নদীর সীমানা অতিক্রম করায় ভারতীয় নৌ বাহিনীর হাতে আটক রয়েছেন আরো শতাধিক। যার ক্ষতিপূরণ এখনো পায়নি জেলে পরিবারগুলো।
সরেজমিনে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভোলার লালমোহনের চর সৈয়দ-সংলগ্ন মেঘনা নদীতে মাছ ধরার নৌকা ডুবে প্রাণ হারান লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ফাতেমাবাদ গ্রামের এক কিশোরসহ ৩ যুবক। নিহতদের মধ্যে রাজিব (১৩), জুয়েল (২০) ও সোহেল (১৮)-এর মরদেহ পাওয়া গেলে পাওয়া যায়নি রিয়াজের (২১) মরদেহ। একই সংসারের উপার্জনকারী দুই সন্তানকে হারিয়ে শোকে কাতর বাবা ছিদ্দিক মাঝি ও মা রাজিয়া বেগম।
বিলাপের সূরে মা রাজিয়া বেগম বলেন, ‘হে দিন ছিল বৃহস্পতিবার, ইলিশ মাছ রান্না কইরা দুই পোলারে খাওয়াইছি। শনিবার রাতে গাঙ্গে বাতাস হইছে, পোলাগোরে মোবাইলে কল দিয়া পাই নাই। এর চাইর দিন পর ছোড পোলাডার লাশ বাইয়া আইলেও বড় পোলাডা আর ফিরা আইলো না’।
বাবা ছিদ্দিক মাঝি বলেন, চাইর দিন পর খবর আইলো গাঙ্গের বাদানির চরে ১২/১৩ বছরের একটা ছেলে ভাসতাসে, হুইন্না সেখানে গিয়া ছোড পোলাডারে পাই। বাড়িতে আনোনের পর ভোলার সার্কেল এসপি আইসা আমার পোলাডার লাশটা জোর কয়রা নিয়া যায়। এসপির হাতে ধইরা এতো কানলাম পোলাডারে শেষ পর্যন্ত নিয়াই গেল। সাত দিন পর ঢালচর জুয়েলের লাশটা পাইলাম। আনার পর তাও পুলিশ আইসা মর্গে নিয়াই গেলো। ১৫ দিন পর কালকিনির চর থেকে ঘলা অবস্থায় সোহেলের লাশ খুইজা আইন্না রাতের বেলা মাডি দেয়। অনেক খোঁজনের পরেও বড় পোলাডার লাশটা আর পায়নি। তিনি তার ভাষায় আরো বলেন, অনেক অভাব অনটনের সংসার। আল্লাই আমাগো কাছ থেকে কামাইকরুন্না পোলাডিরে নিয়া গেছে। কোন সাহস্য সহযোগীতা আমাগো ভাগ্য জোডেনী। এখন কনরকম মাইনের নৌকার জাল দইরা খাই’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তিনি।
এদিকে একই নৌকায় নিহত জুয়েল ও সোহেলকে হারিয়ে শোকে কাতর তাদের স্বজনরা। তাদের ভাগ্যে ও কোন সরকারী বে-সরকারী কোন সহযোগীতা জোটেনে বলে জানান নিহত জুয়েলের মা ফাতেমা বেমগ। তার কয়েক মাস আগে একই এলাকার সিরাজ মাঝি (৪০) নদী মাছ ধরতে গিয়ে সামছুদ্দিন মাঝির নৌকা থেকে সাগরে পরে নিখোঁজ রয়েছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে এসকল জেলে পরিবারের সংসার চলে অনাহারে অর্ধাহারে।
শুধু রাজিয়া বেগম আর ফাতেমা বেগম নয়, এই রকম হাহাকার ভোলার বিভিন্ন উপজেলার শত শত জেলে পারিবারে।
ভোলা জেলা জেলে সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ১৫ সাল পযর্ন্ত তেতঁলিয়া ও মেঘনা নদীতে জলদস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিহত হয়েছেন লালমোহনের লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের জসিম উদ্দিন, ফাতেমাবাদ গ্রামের কিশোর রাজিব, জুয়েল, সোহেল, রিয়াজ। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরের আঃ গণি, জাহানপুরের আলাউদ্দিন, নুরাবাদের ফরিদাবাদ গ্রামের আঃ খালেন। মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের সিরাজ উদ্দিন, ৪ নং ওয়ার্ডের মহিউদ্দিন, ৫ নং ওয়ার্ডের নরুন্নবী । দৌরতখান উপজেলার চর খলিফার আলমগীর, চর সৈয়দ পুরের মো. হিরণ ও জলসদ্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন দৌলতখান পৌরসভার সামছুদ্দিন মিয়া। তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বেলায়েত হোসেন, দক্ষিণ চাচড়ার জাকির হোসেন, চর জহির উদ্দিনের বেল্লাল হোসেন, নিচতপুর গ্রামের সেলিম সহ প্রায় ৬ শত জেলে।
লালমোহন উপজেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি ও লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাসেম বলেন, নিহত জেলের তালিকা ও তাদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য আবেদন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে কোনো সহযোগিতা আসলে তা নিহতের পরিবারদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
ভোলা সদর উপজেলা জেলে সমিতির সভাপতি এরশাদ হোসেন বলেন, শুধু জলদস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। নদীর সীমানা অতিক্রম করায় ভারতীয় নৌ-বাহিনী জেলেদের জাল, নৌকা ট্রলারসহ অনেক জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। যাদের এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, ঝড়-জলোচছাসের সময় উপকূলীয় বনে আশ্রয় নিতে গিয়ে সেখানেও বন রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রভাবশালীদের চাঁদা দিতে হয়। এতে অসহায় হয়ে পড়েছেন জেলেরা।এসকল বিষয়ে প্রশাসনের জোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জেলা জেলে সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, জেলারা তাদের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ঝড়-জলোচ্ছ্বাস উপেক্ষা করে নদী সাগরে মাছ ধরতে যায়। সেখানে জলদস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরে নিহত হচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে না। তিনি জেলেদের জন্য ভাসমান কমিউনিটি ক্লিনিক, রেসনিং ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জেলেপাড়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ভাতা ও বিকল্প কর্মসংস্থান, জলদস্যু দমনে প্রসাশনের আরো নিরাপত্তা জোরদার, ভারতে আটক জেলেদের ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের সহযোগিতা সহ জেলেদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবি জানান তিনি।
সম্পাদনা: ফরহাদ হোসেন