বুধবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » জাতীয় » আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর ! ৪৫ বছর পরেও আতকে উঠে ভোলা সহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর ! ৪৫ বছর পরেও আতকে উঠে ভোলা সহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ
বিশেষ প্রতিনিধি: আজ সেই ভয়াল ১২ ই নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনের প্রলংয়নকারী জলোচ্ছ্বাসের স্মৃতি আজো ভোলা সহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে কাদায়। ৪৫ বছর পরেও আতকে উঠে স্বজন হারানোদের হৃদয়। আজকের এই দিনের জলোচ্ছ্বাসে লন্ডবণ্ড হয়ে যায় দ্বীপ জেলা ভোলাসহ উপকূলীয় অসংখ্য জনপদ। মূহুত্বের মধ্যেই জনপদগুলোকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে দেয়। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট এমনকি গাছের সাথে ঝুলে ছিলো শত শত মানুষের লাশ। দুর্যোগের সেই জলোচ্ছ্বাসে গৃহহীন হয়ে পড়ে দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে ছিলো বঙ্গোপসাগরের মহনার চর কুকড়ি-মুকড়ি ও ঢালচরের বাসিন্দাদের। সেদিনের জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি ঘটে ভোলার লক্ষাধিকসহ উপকূলের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ওই সময় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায় এক সপ্তাহ পরে। সে সময়ের সংবাদ পত্রগুলোর প্রধান শিরোনাম আসে ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে লাশ, দক্ষিণ উপকূলে লাশের গন্ধে আকাশ বাতাশ ভারি হয়ে উঠেছে। আর সেই সময়ে বেঁচে যাওয়াদের স্বজন হারানোর স্মৃতি এখনও তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
জানা গেছে, আজ সেই ভয়াল ১২ ই নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনটি ছিলো রোজার দিন। সারা দিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিসহ টানা বাতাস বই ছিল । উপকূলের উপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। শুধু রেখে যায় ধ্বংসযজ্ঞ। বহু মানুষ তাদের প্রিজনের লাশ খুঁেজও পায়নি। জলচ্ছ্বাসের পর থেকে দেড়মাস পর্যন্ত স্বজন হারানোদের কান্নায় উপকূলের আকাশ পাতাল ভারী ছিল। গত ৪৫ বছরের সব কয়টি ঘূর্ণীঝড়ের চেয়ে ৭০’র ঝড়টি সব চাইতে হিংস ছিল বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান । ৭০’র এর হ্যারিকেনরুপী এ ঝড়টি উপকূলীয় ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ ১৮টি জেলায় আঘাত হানে। তৎকালীন সময় তথ্যপ্রযুক্তি অনেকটা দুর্বল থাকায় উপকূলের অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বভাস পায়নি। ওই জলচ্ছ্বাস হয়েছিল ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতায়। কেউ গাছের ডালে, কেউ উঁচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনমতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ৩ থেকে ৪ দিন তাদের অভুক্ত কাটাতে হয়েছে।
তজুমদ্দিন উপজেলার চাচড়া এলাকার মাকসুদ আলম পরিবারের ৬ সদস্যের মধ্যে বেঁচে যাওয়া একজন। তিনি সেদিনের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সকাল থেকেই আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন ছিল। দুপুরের পর থেকে আস্তে আস্তে বাতাস বইতে শুরু করে। বিকেলের দিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যায় বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। এরপর বাতাস ও বৃষ্টির প্রচন্ডতা বেড়ে যায়। রাত ২টা আড়াইটার দিকে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া ও বঙ্গোপসাগরের জলচ্ছ্বাসের পানি ১৪ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোটা জেলা তলিয়ে যায়। এ সময় মির্জাকালু বাজারে সদর রোডের ওপরে ৪ থেকে ৫ ফুট পানি ওঠে। পানি আসতেছে বলে বাজারের আশ-পাষ থেকে বহু নারী, পুরুষ ও শিশু ছুটোছুটি করে হাই স্কুলের দোতালায় আশ্রয় নেন। পরদিন ১৩ নভেম্বর ভোরে জলচ্ছ্বাসের পানি যখন নামতে শুরু করে তখন প্রচন্ড বেগে পানির ¯্রােতের সাথে মাছ ধরার ট্রলার ও লঞ্চ বাজারে এসে পরে। তখন পানিতে ভেসে যাচ্ছে অগণিত মানুষের লাশ। বিভিন্ন গাছের মাথায় ঝুলতে দেখা গেছে মানুষ ও পশুর মৃতদেহ। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ।
সত্তরের সেই কালো রাতের কথা মনে হলে ধুসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসে হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। ¯েœহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শূণ্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা। সেই সময়কার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলার সমস্ত জনপদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল আর নদীতে গবাদি পশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়েছিলো। এসব সংবাদ তৎকালীন “পূর্বদেশ” পত্রিকার ভোলাস্থ প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন “বাংলার মানুষ কাদো, ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ” শিরোনামে ছাপা হয়েছিলো। আর এ সংবাদ বিশ্বব্যাপী ৪দিন পর জানতে পেরেছিলো। সেই চিত্রটি আজো ঢাকা প্রেস ইনষ্টিটিউট-এ কালের স্বাক্ষী হিসেবে বাধানো অবস্থায় প্রদর্শিত হচ্ছে।
চরফ্যাশনের বঙ্গোপসাগর মহনার ঢাল চরে বেঁচে যাওয়া নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, ঢাল চরে তখন প্রায় সাতশ লোকের বসবাস ছিলো। ওই জলচ্ছ্বাসে গোটা চরটাকে তছনছ করে সব মানুষগুলোকে সাগর দিকে ভাসিয়ে নিয়েগেছে। এর মধ্যে আমার কয়েকজন আল্লাহর রহমতে বেঁচে যায়।
ঝড়ের বর্ণনা করতে গিয়ে মনপুরার ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা হাবিবা খাতুন বলেন, সেই ভয়াল জলচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় অথৈ পানিতে একটি ভাসমান কাঠ ধরে প্রায়মৃত অবস্থায় গভির সাগরের মধ্যে থেকে আল্লাহ আমাকে বাচিয়ে দেন।
বেচেঁ যাওয়া চর ছকিনা গ্রামের কাতার প্রবাসী সাদেক হাওলাদার বলেন, আমার বয়স তখন বেশী নয়। আমি লালমোহন বাজারে আমাদের দোকানের ভিতর পানিতে আটকা পড়েছিলাম। ঝড়ের কবলে একটা সাপও দোকানে ভিতর ঢুকেছিলো। পরে দোকানের ভির কেরসিনের টিনের উপর টিন রেখে মৃত্যুর হাত থেকে আল্লাহর বিশেষ রহমতে বেঁচে যায়। পরে দিন সকালে আমার বাবা ভেলাতে করে এসে আমাকে উদ্ধার করে বাড়ি নেওয়ার পথে লালমোহন থানার পূর্বপাশে পাঞ্চায়েত বাড়ির কালভার্টার কাছে যে কি পরমান লাশ এসে জমা হলো তা বর্ণনা করে শেষ করা মত নয়। তিনি আরো বলেন, জলচ্ছ্বাসে তখন বাজার সহ আমাদের গ্রামের সকল ঘর পড়ে গিয়ে সব লন্ড বন্ড হয়ে যায়। কেও না দেখলে বিশ্বাস করবে না কিভাবে পানি নেমেছে। সমুদ্র মনে হয় পিপাসিত ছিলো। অল্প সময়ে এতো পানি উল্কার গতিতে নেমে গেলো আর স্রোতের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সব কিছু। মেঘনার পাড়ের মানুষগুলোকে পানির নীচে ডুবিয়ে দিয়েছে। বেড়ীঁর পাড়ের জায়গা দেখলে কেও বুঝতে পারতোনা একদিন আগে এখানে বাড়ি ছিলো, পুকুর ছিলো। জলচ্ছ্বাসে সব সমান হয়ে গেছে। লাশের গন্ধে হাটা যেতোনা।
স্বজন হারানো পরিবারের একজন ভোলা প্রেস ক্লাবের সদস্য জহিরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, আমার মাসহ পরিবারের লোকজনকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জলোচ্ছ্বাসে, আমি বেঁচে থেকে প্রতিবছর এই দিনে এলেই সেই শোকে দিশে হারা হয়ে পড়ি। স্বজন হারা আরেক পরিবারের সদস্য ও আর কে ট্রেডিং এর ব্যবসায়ী লক্ষণ বণিক বলেন, আমার দাদা বাড়ি তজুমুদ্দিনের গুড়িন্দা বাজার ছিল। ঝড়ের আগে রাতে শো শো শব্দ আর ভয়ে আমার মা আবা রানী বণিক ভোলায় মামার বাড়ী চলে আসেন। ঝড়ও জলোচ্ছ্বাসের পর আমার মা দাদা বাড়ি গিয়ে দেখেন দাদা নকুল বণিকসহ পরিবারের পরিপরিজনরা ভেসে গিয়েছেন। সেই স্মৃতি মনে পড়লে মা আজও কেমন যেন হয়ে পরেন।
ভোলা সদরের আলীনগর ইউনিয়নের সাচিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আলমগীর মিঝি বলেন, ওই বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। বাড়ী একটু দুরে থাকায় তিনি দৌলতখান বাজারের একটি দোকান ঘরের মধ্যে থেকে পড়া-লেখা করছিলেন। রাতের বেলা দেখেন প্রবল বেগে পানি আসছে । উপায়ন্তুর না দেখে তিনি ওই পানির মধ্যে ঝাপ দিয়ে পাশের দোকানের বেড়াটি ধরলেন। পরে তিনি দোকানের উপরে থাকা লোকজনকে ডাক দিলে তারা তাকে উপরে তোলেন। সকাল বেলা তিনি বাড়ীতে গিয়ে দেখেন যে, ঘরগুলো বন্যায় ভেঙ্গে দুমরে-মুচরে গেছে। যাওয়ার সময় তিনি পথে পথে হাজারো লোকের মরদেহ পরে থাকতে দেখেছেন। এমনকি বিভিন্ন গাছের সাথে মরদেহগুলো ঝুলতে দেখেছেন। ওই বন্যার সময় তাদের ঘরে লোকজন ছিলনা। তাই বড় ধরনে কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি। তবে তাদের বাড়ী থেকে প্রায় ৩৯ জনের মত লোক ওই বন্যায় প্রাণ হারায়।
৭০’র ভয়াভহ জলোচ্ছ্বাসে পর ভোলার বিভিন্ন অঞ্চলে লাশের সৎকার ও বেঁচে থাকা মানুষদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রিলিফ বিতরণ করতে গিয়ে যে দৃশ্য পেয়েছি তা বর্ণনা করতে গিয়ে ভোলা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফজলুলকাদের মজনু মোল্লা, ভোলা জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ মোফাজ্জল হোসেন শাহীন, জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম নিরব মোল্লা স্মৃতি চারণ করে বলেন, যারা সে সময় বেঁচে ছিলেন তাদের পাশে যখন গিয়েছি তখন কি করব ভেবে পাইনি।
জননেতা মাওলানা ভাষানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানসহ যারা এদৃশ্য দেখতে আসেছেন আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেন এবং তারা বলেন, সেই সময়ের শাসক (ইয়াহিয়া খান’রা) বাংলার স্বজন হারাদের পাশে এগিয়ে আসেন নি এবং তাদের খোজ পর্যন্ত নেন নি। তখন সারা বিশ্বব্যাপী তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্টিকে ধিক্কার দিয়েছিল। এখনো স্বজন হারা পরিবার গুলো যেভাবে আছে তাদের পাশে সকলেই দাড়ানো উচিত বলে তারা অভিহিত করেন।
ওই দিনে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চল যেন লাশের মিছিল পরিনত হয়েছিল। গোটা জেলাকে তছনছ করে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে দিয়েছিলো সেই দিনের ভয়ংকর প্রলংয়নকারী ঘূর্ণী ঝড়। সেই স্মৃতি মনে পরলে আজো দ্বীপ জেলা ভোলা সহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হৃদয় আতকে উঠে।