বৃহস্পতিবার ● ২৯ অক্টোবর ২০১৫
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » বিএনপি থেকে শমসের মবিনের পদত্যাগ: নেপথ্যে আঁতাতের গুঞ্জন
বিএনপি থেকে শমসের মবিনের পদত্যাগ: নেপথ্যে আঁতাতের গুঞ্জন
ঢাকা : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপির সকল পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে বুধবার রাতে খালেদা জিয়া বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। এ ব্যাপারে শমসের মবিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার সকালে নিজ বাস ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মুহূর্তে চেয়ারপারসন বিদেশে থাকায় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে পদত্যাগপত্র দেয়া হয়। তিনি (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) তা গ্রহণ করেছেন। শমসের মুবিন বলেন, আমি যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা। শারীরিকভাবে রাজনীতি করার মতো অবস্থায় এখন আর নেই। এ কারণে বিএনপির সব পদ থেকে সরে গিয়ে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ওই পদত্যাগপত্রে শমসের মবিন চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসাও নিয়েছি। বর্তমানে আমার অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। অবসর গ্রহণের প্রেক্ষিতে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সকল পদ থেকেও পদত্যাগ করলাম। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মুল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস আমার চিরকাল থাকবে।বিএনপির সব পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, যিনি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের খুবই ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।বৃহস্পতিবার তিনি জানান, অবসরে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে তিনি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে একটি �চিঠি� লিখেছেন। বুধবার রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে ওই চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।আমি যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা। শারীরিকভাবে এখন আর রাজনীতি করার মতো অবস্থায় নেই। এ কারণে বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন থেকেই তা কার্যকর হবে।বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন একাত্তরে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে ছিলেন। মেজর পদে থাকা অবস্থায় তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে শমসের মবিন চৌধুরীকে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৭ সালে তিনি অবসরে যান। ২০০৮ সালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিএনপিতে যোগ দেন শমসের মবিন চৌধুরী। সে সময় চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান তিনি।২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিল হলে শমসের মবিনকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। কখনো নির্বাচনে অংশ না নিলেও গত কয়েকবছর তিনি বিএনপির মূল ক্ষমতাকেন্দ্রের খুব কাছাকাছিই ছিলেন।এমন এক সময়ে তিনি দল ও রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিলেন, যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হয়ে কঠিন এক সময় পার করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার কথা বলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে সেখানে বড় ছেলে তারেক রহমানের কাছেই অবস্থান করছেন। আর দেশে দলের কার্যক্রম কেবল মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপনের প্রেস ব্রিফিংয়ের মধ্যেই দৃশ্যমান।চলতি বছরের শুরুতে বিএনপি ও শরিকদের টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হন শমসের মবিন। গত মে মাসে জামিনে মুক্তি পেলেও এর পর আর তাকে রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় দেখা যায়নি। প্রোস্টেট ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন জানিয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য আমার বিদেশে যাওয়া জরুরি। এমআরপি পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনও আমাকে তা দেওয়া হয়নি। রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণা দিলেন বিএনপির কূটনৈতিক টিমের অন্যতম সদস্য শমসের মবিন চৌধুরী। বুধবার দলের চেয়ারপারসন বরাবর পদত্যাগপত্র লিখে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে দিয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিজে নিশ্চিত করলেও মির্জা ফখরুল ইসলাম বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে অস্বীকার করেছেন।দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে শমসের মবিন চৌধুরীর হঠাৎ করে পদত্যাগের ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার নানা গুঞ্জনের জন্ম দিচ্ছে।অবসরের ব্যাপারে শমসের মবিন চৌধুরী জানিয়েছেন, কোনো রাজনৈতিক চাপ নয়, স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। সুস্থ হলে ভবিষ্যতে দেশের কল্যাণে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তিনি।দল বদলে বিশ্বাস করেন না জানিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী।এদিকে, তার এ পদত্যাগের বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য শমসের মবিন চৌধুরী দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।দলের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাস থেকেই ঘটনার মূল সূত্রপাত। কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি লাভের পর থেকেই সরকারের সঙ্গে তার এক ধরনের �আঁতাত� হয়েছে বলে চাউর হয় বিভিন্ন মহলে। বিষয়টি বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহলে খোলাসা হলে দলের মধ্যে তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বারবার দেখা করার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা না হওয়া প্রসঙ্গে শমসের মবিন চৌধুরী জানান, অসুস্থ থাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। অপর একটি সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া বৈঠক না করায় বিএনপির একটি পক্ষ এর দায়ভার শমসের মবিন চৌধুরীর ওপর দিয়েছে। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের আন্দোলন চলাকালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে শমসের মবিন চৌধুরীর একটি অডিও ক্লিপ গণমাধ্যমে প্রচার হয়। ওই ক্লিপে তারেক রহমান শমসের মবিনকে ভর্ৎসনা করেন। অন্য একটি সূত্রমতে, দলে শমসের মবিনের মূল্যায়ন না হওয়ায় রাগে ক্ষোভে তিনি পদত্যাগ করেছেন। তবে এ ব্যাপারে শমসের মবিন চৌধুরীর বক্তব্য হচ্ছে- দলে তিনি সব সময় সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন। যখন যে কাজ করতে চেয়েছেন তখন সে সুযোগ তিনি পেয়েছেন।অবসরের ঘোষণা দিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছেন, শহীদ জিয়ার বিএনপি তার আদর্শের জায়গায় রয়েছে কি না সেটা একটা প্রশ্ন।এদিকে তার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন বিএনিপর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার পদত্যাগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুও।আরেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি দলের অতবড় নেতা নন। রাজনীতিতে সব সময়তো সুবিধা পাওয়া যায় না।দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটর সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ডিটেইল আমি জানি না। খবরটা আপনার কাছেই শুনলাম। যেহেতু আমি জানি না সেহেতু আমার কোনো মন্তব্যও নাই। শুনেছি স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন। স্বাস্থ্যের চেয়ে তো বড় কিছু নেই। প্রথম হলো জীবন পরে হলো রাজনীতি।শমসের মবিন চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলায়। তার বাবার নাম আব্দুল মবিন চৌধুরী এবং মায়ের নাম তাহমেদুন নাহার। তার স্ত্রীর নাম শাহেদা ইয়াসিমিন। তাদের দুই ছেলে।১৯৭১ সালে শমসের মবিন চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধ যুদ্ধকালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের যুদ্ধে তিনি আহত হন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হন। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করে। শমসের মবিন চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত থাকাকালে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে পররাষ্ট্র সচিব পদে উন্নীত হন এবং পরে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন। ২০০৯ সালে বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলে ভাইস চেয়ারম্যান পদ পান শমসের মবিন চৌধুরী।