

মঙ্গলবার ● ১১ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » জেলার খবর » ভোলায় বিষপানে রিকশা চালকের আত্মহত্যা
ভোলায় বিষপানে রিকশা চালকের আত্মহত্যা
স্টাফ রিপোর্টার: ভোলা সদরের ২নং ইলিশায় ইউনিয়নের রিকশা চালক নিজাম উদ্দিন সিকদার (৪০) বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে। গত শনিবার (৮ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ইউনিয়নের গুপ্তমুন্সী এলাকায় নিজ বাসায় বিষপান করে নিজাম। পরে তাকে উদ্ধার করে ভোলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করেন। রবিবার (৯ এপ্রিল) ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে নিজামের জানাজা শেষে দাফন করা হয়। এই ব্যাপারে ভোলা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) এনজিওর কিস্তির টাকা নিয়ে নিজাম উদ্দিন সিকদার ও তার স্ত্রী জান্নাত বেগমের সাথে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে নিজাম তার স্ত্রীকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরে নিজামের স্ত্রী জান্নাত বেগম ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ছোটনের কাছে বিচার দেয়। ইউপি চেয়ারম্যান ছোটন স্বামী-স্ত্রীর পক্ষের কথা শুনে তাদেরকে মিলমিশ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বাড়িতে এসে সন্ধ্যায় নিজাম সিকদার তার বাসায় কিটনাশক পান করেন। তার স্ত্রী টের পেয়ে দেবপুত্র রিয়াজসহ নিজামকে দ্রুত ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার নিজামকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ছোটন বলেন, নিজামের স্ত্রী জান্নাত বেগম তার দুই সন্তান নিয়ে আমার কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে বিচার দিয়েছে। তার স্ত্রী আমাকে বলছে ৪দিন আগে নিজাম তাকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। এখন সে ভয়ে বাসায় যেতে পারছে না। সে নিরাপত্তাহীনতায় আছে। জান্নাত আমাকে বলে আপনি একটা ব্যবস্থা করেন। জান্নাত বেগমের কথা শুনে আমি নিজামকে ফোন দিয়েছি। নিজাম ফোন না ধরায় আমি লোক পাঠিয়ে নিজামকে আমার অফিসে ডেকে এনেছি। সেখানে অনেক লোক উপস্থিত ছিলো। লোকজনের উপস্থিতিতে আমি নিজামকে জিজ্ঞাসা করেছি যে তুমি তোমার স্ত্রীকে কেনো মারধর করেছো। এসময় নিজাম আমাকে বলছে সে তার স্ত্রীর কাছে ২০ হাজার টাকা চেয়েছে টাকা না দেওয়ায় সে তার স্ত্রীকে মারধর করেছে এবং তার একটি বোরাক আছে সেটিও তার স্ত্রী বিক্রি করতে দিচ্ছে না। তার স্ত্রী টাকা না দেওয়া ও বোরাক বিক্রি করতে না দেওয়া সে স্ত্রীকে মারধর করেছে। এসময় আমি নিজামকে জিজ্ঞাস করেছি তোমার স্ত্রীকে তুমি ভরণপোষণ কি দেও। তখন নিজাম বলছে ১ কেজি চাল ও ১ পোয়া ডাল দেয়। আমি তখন বলেছি এতে তো একটি সংসার চলে না। এক পর্যায়ে নিজাম আমার সাথে খারাপ আচরণও করে। আমি তখন নিজামকে ভয় দেখানোর জন্য বলছি আমি তোমাকে থানায় ওসির কাছে দিয়ে দিবো, তখন নিজাম উত্তরে বলে দিয়ে দেন। আমি বললাম তোমাকে মারবো, নিজাম তখন বলে মারেন। তারপরও সে স্ত্রীকে নির্যাতন বন্ধ করবে না। এসময় তার স্ত্রী আমাকে বলে চেয়ারম্যান সাহেব আপনি তাকে দুইটা থাপ্পর দেন। তখন আমি বললাম এখন রমজান মাস, আমি তাকে মরবো না। পরে নিজামকে পাশের একটি যায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। এসময় নিজামের ভাতিজা এসে আমাকে বলেন, আমার চাচা-চাচীর সাথে যেটা হয়েছে আমি এটা মিমাংসা করে দিবো, আপনি দুজনকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেন। আমি যখন তাদেরকে বাসায় পাঠাবো তখন নিজাম আমাকে বলে, আমার ছেলেকে ডেকে আনেন চেয়ারম্যান সাহেব। আমার ছেলে এসে যেটা বলবে সেটাই হবে। তখন আমি তার ছেলে ইমরানকে ডেকে এনেছি। ইমরানকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, তোমার বাবা-মায়ের সাথে যে ঘটনাটা ঘটেছে এই ঘটনায় বেশি দোষি কে? তখন নিজামের ছেলে ইমরান সকলের সামনে বলছে তার বাবা-মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় তার বাবা সবচেয়ে বেশি দোষি। তখন নিজাম তার ছেলেকে বলছে, তুই আমার সন্তান, তোকে লালন পালন করে বড় করেছি, তুই ভরা মজলিসে আমাকে আমাকে অপমান ও ছোট করলি। সবার কথা শুনে আমি নিজামকে বললাম তোমার স্ত্রীকে সংসার চালানোর জন্য প্রতিদিন ৫০০ করে টাকা দিবে তাহলে তোমার স্ত্রী আর অন্য কোথায় কাজ করবে না। তাৎক্ষনিক নিজাম ওই দিনের জন্য ৫শ’ টাকা বের করে দেয় এবং প্রতিদিন গাড়ি চালিয়ে ৫শ’ টাকা করে দিতে রাজি হয়। এরপর তাদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দেই। পরে রাত ৮টার দিকে আমি শুনতে পেয়েছি নিজাম বিষপান করেছে। খবর পেয়ে আমি তাৎক্ষনিক হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতলে গিয়ে শুনি নিজাম মারা গেছে। একটি চক্র অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, আমি নিজামকে বেধে রেখে নির্যাতন ও মারধর করায় সে বিষপান করে আত্মহত্যা করছে। আমি নিজামকে কোন ধরনের নির্যাতন ও মারধর করিনি। একটি অপশক্তি আমাকে হয়রানী করার জন্য অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।
নিজামের স্ত্রী জান্নাত বেগম বলেন, আমার স্বামী আমাকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেওয়ায় আমি চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিয়েছি। চেয়ারম্যান আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে আমার স্বামীর, আমার ও আমার ছেলের কথা শুনে আমাদেরকে মিলমিশ করিয়ে বাসায় পাঠি দিয়েছেন। আমরা বাসায় আসলে আমার স্বামী ঘরে তালা মেরে রাখে। আমাদেরকে ঘরে ডুকতে দেয়নি। পরে আমার দেবরের ছেলে রিয়াজ আমার স্বামীকে বুজিয়ে তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে ঘরের তালা খুলে দিলে আমরা ঘরে প্রবেশ করি। তখন আমার স্বামী বাসায় এসে কান্না করে বলছে আমার ছেলেকে কষ্ট করে লালনপালন করে বড় করেছি, এখন আমার ছেলে মানুষের সামনে আমাকে অপমান করেছে। আমি এই জীবন আর রাখবো না। এই বলে ঘরে কান্না কাটি করে কিছুক্ষন পর বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেছে। সন্ধ্যার দিকে আমার স্বামী বাসায় এসে বিষপান করে বাসায় শুয়ে ছিলো। পরে তার বিষপান করার বিষয়টি দেখতে পেয়ে আমি ও আমার দেবরের ছেলে রিয়াজকে নিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে ডাক্তার তাকে বরিশাল নিতে বলে বরিশাল নেওয়ার পথে আমার স্বামী মারা যায়। জান্নাত বেগম বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব আমার স্বামীকে শালিসে বেধেঁ রেখে কোন মারধর ও নির্যাতন করেনি। আমাদেরকে মিলমিশ করে পাঠিয়ে দিয়েছে।
নিজামের ছেলে ইমরান বলেন, আমাকে শালিসের সেখানে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে আমার বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়ায় কার দোষ বেশি। তখন আমি বলেছি আমার বাবার দোষ বেশি। তখন আমার বাবা আমাকে বলছে, তোকে লালন পালন করে বড় করেছি। তুই আমার পোলা হয়ে সবার সামনে আমাকে অপমান করলি। এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি। বাসায় এসে বাবা অনেক কান্না কাটি করে বলছে আমার পোলাপানকে লালনপালন করে বড় করেছি। তারা এখন সবার সামনে আমাকে অপমান করেছে। আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে। আমি এই জীবন রাখবো না।
নিজামের ভাই মোঃ নিরব ও ভুট্টু সিকদার বলেন, নিজাম ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলে আসছে। বিষয়টি নিয়ে তাঁর স্ত্রী জান্নাত বেগম স্থানীয় (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ছোটনের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। এ অভিযোগের ভিত্তিতে শনিবার বিকেলে চেয়ারম্যানের অফিসে ডেকে নেয়। আমার ভাই নিজামকে শালিসি বৈঠকে বেঁধে রেখে অপমান ও অপদস্ত করায় সে বাড়িতে গিয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছে। আমরা এ ঘটনার সঠিক বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
ভোলা সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন ফকির জানান, নিহতের লাশের ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। নিহতের ভাই একটি অভিযোগ দিয়েছেন। তবে সেখানে কাউকে নির্দিষ্ট করে অভিযুক্ত করা হয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
-এসজে/এফএইচ