রবিবার ● ২৫ মার্চ ২০১৮
প্রথম পাতা » জাতীয় » ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ
ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ
ডেস্ক: আজ ভয়াল ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এইদিনে বাঙালি জাতির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত নেমে আসে। পূর্বপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কাপুরুষের মত অপারেশন সার্চ লাইট চালায়। স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদাররা।
এই কালো রাত স্মরণে গতবছর থেকে এটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস করা হয়েছে। গতবছরের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। জাতীয়ভাবে ২৫ মার্চ রাতে সারাদেশে এক মিনিটের জন্য (কেপিআই ও জরুরি স্থাপনা ছাড়া) প্রতীকী ব্ল্যাক-আউট কর্মসূচি পালিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক পত্রে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ রাত নয়টা থেকে নয়টা এক মিনিট সারাদেশে এই প্রতীকী ব্ল্যাক-আউট কর্মসূচি পালিত হবে।
দিবসটি পালনে রোববার সকাল ১০টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ গণহত্যার ইতিহাস’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শন ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ড ছিল না। এটি ছিল মূলতঃ বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘণ্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র।
অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যে, শুধুমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘণ্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী নয় মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল সেই বর্বর ইতিহাসকে।
তাদের সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ সবই ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ শীর্ষক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে বর্ণিত সংজ্ঞায় গণহত্যার চূড়ান্ত উদাহরণ।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তনের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
২৫ মার্চ দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এদিন সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। হেলিকপ্টার যোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।
ঢাকার ইপিআর সদর দফতর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
এদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়।
সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান।
সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান।বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
২৫ মার্চ পালনের কর্মসূচি
জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রোববার বিকেল চারটায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যৌথ উদ্যোগে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করা হবে। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে- সন্ধ্যা সাতটায় স্মৃতি চিরন্তনে মোমবাতি প্রজ্বলন, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও আলোচনা সভা।
এছাড়া, বাদ জোহর মসজিদুল জামিয়ায় ২৫ মার্চের রাতে নিহতদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে প্রার্থনা সভা।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ রোববার সন্ধ্যা ছয়টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্জ্বলন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। দলটির সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এতে যোগ দেবেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল যৌথভাবে গণহত্যা দিবস স্মরণে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পুরানা পল্টনের মুক্তিভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন পর্যন্ত আলোর মিছিলের আয়োজন করেছে।
-পিডি/এফএইচ