সোমবার ● ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » জেলার খবর » ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পরও ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি উপেক্ষিত
ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পরও ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি উপেক্ষিত
বিশেষ প্রতিনিধি : এখন ফেব্রুয়ারী মাস। ২১ ফেব্রুয়ারী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর ভোলা জেলার কৃতি সন্তান ভাষা সৈনিক মরহুম রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) ও তার পরিবার আজো উপেক্ষিত। মহান এ ব্যক্তির স্মৃতি সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। তার স্মরণে নির্মান করা হয়নি কোন নামফলক। ভোলাবাসী দীর্ঘদিন ধরে মরহুম ভাষা সৈনিকের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসলেও সেই দাবি উপেক্ষিতই রয়ে গেলো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মরহুম রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার ছোট ছেলে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মাহবুব উল আলম চৌধুরী অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার বাবা মরহুম রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) একজন ভাষা সৈনিকই শুধু ছিলেননা, তিনি উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬৫ বছরেও মরহুম এ ভাষা সৈনিকের স্মৃতি সংরক্ষণে নূন্যতম কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা শুধু পরিবারের নয়, এ দাবি এখন ভোলাবাসীর। এলাকাবাসীর এ দাবি আজো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। তিনি জানান, ভোলার কৃতি সন্তান সাবেক এমপি ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সংবিধান প্রনেতা মরহুম রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) ২০০৭ সালের ২ মার্চ শুক্রবার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বার মিয়া বাড়িতে মৃত্যুবরন করেন। ওই বাড়িতেই তিনি জন্ম গ্রহন করেছিলেন ১৯৩২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর।
এ ভাষা সৈনিকের প্রতি কিংবা তার পরিবারের প্রতি কোন সরকার তেমন কোন খবর রাখেনি। প্রায় একই কথা বললেন ভাষা সৈনিকের বড় ছেলে বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির চৌধুরী। বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, জীবদ্দশায় আমার বাবা আমাদেরকে জানান, তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যায়ন করার সময় মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৫২ সালে জিন্নাহর রাষ্ট্র ভাষা উর্দু ঘোষনার পর তার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। তখন তিনিসহ তার এক সহপাঠী তাৎক্ষনিকভাবে ঢাকা কলেজের ভিপি ইকবাল আনসার হেনরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সর্বদলীয় বাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃরৃন্দের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান সরকার অপরাহ্নে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা পূর্বেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চুন্নু মিয়া তখন বলেছিলেন, আমরা জানতাম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে গেলে নিশ্চিত গুলি হবে। তারপরও মায়ের ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালবাসা আমাকে মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। হঠাৎ মনে পড়ে আমি যদি আগামীকাল মিছিলে গিয়ে গুলিতে শহীদ হই তাহলে আত্মীয়-স্বজনরা আমার লাশের সন্ধান হয়তো পাবেনা। এ কথা ভেবে আমি রাতে বসেই আমার পুরো নাম ঠিকানা সাদা কাগজে লিখে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। যাতে এ ঠিকানা অনুযায়ী আমার লাশ অন্তত স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারী ভোর থেকেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের পরামর্শ অনুযায়ী ৮/১০ জনের খন্ড মিছিল শুরু হলো। তাদের কলেজের তৃতীয় ব্যাচের মিছিলে ছিলেন চুন্নু মিয়া। তাদের মিছিল যখন কলাভবনের কাছে পৌঁছুল তখন তাকেসহ অনেককে আটক করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। রাতে তাদের ফাঁড়িতে অবস্থান করতে হয়। সকালে পুলিশ ভ্যানে করে তাদেরকে কোর্টে নিয়ে যায়। কোর্টে হাজির না করেই এক ঘন্টার মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হলো। এরপর এক মাস কারাভোগের পর বেরিয়ে আসেন মরহুম ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া।
কারাভোগকারী ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়া মৃত্যুর প্রায় দুই বছর আগে বিশাল প্রাপ্তির সুরে এ প্রতিবেদককে জানালেন, একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ায় তিনি গর্বিত। তবে তিনি চান বাংলাভাষা সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হোক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে অভিবাবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭০ সালে চুন্নু মিয়া আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া এরশাদ সরকারের আমলে বোরহানউদ্দিন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি নিজেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি। একাধারে চারটি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি শুধু গ্রাজুয়েট হয়েও আব্দুল জব্বার কলেজে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের তার লেখা বই “অনন্য সাধন” সকলের প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু “খেকশিয়ালের অধঃপতন” পান্ডুলিপি জীবদ্দশায় তিনি প্রকাশ করে যেতে পারেননি।
ভাষা সৈনিকের মেঝ ছেলে বোরহানউদ্দিন উপজেলা চেয়ারম্যান মহব্বত জান চৌধুরীও ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তার বাবা চুন্নু মিয়া ২০০৭ সালের ২ মার্চ মারা যাওয়ার পর তৎকালিন জেলা প্রশাসক মোঃ বেলায়েত হোসেন আশ্বাস দিয়েছিলেন ভোলায় ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়ার স্মৃতি রক্ষায় তার নামে যে কোন একটি সড়ক নামকরন করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত মরহুম ভাষা সৈনিকের নামে কোন সড়ক নামকরন করা হয়নি। মরহুম ভাষা সৈনিকের স্ত্রী নুরজাহান বেগমসহ মরহুমের ছেলে-মেয়েদের প্রশ্ন রাষ্ট্রের কি উচিত না মরহুম এই ভাষা সৈনিকের সম্মানের জন্য তার স্মৃতি সংরক্ষণ করা? এ ব্যাপারে বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জোবায়েদ মিয়া জানান, ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার মৃত্যুর পর এলাকাবাসীর দাবি ছিল তার নামে নিজ এলাকায় অন্ততঃ একটি সড়কের নামকরণ করা হোক। তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ বেলায়েত হোসেনের কাছে এলাকাবাসীর দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছিল।
ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়ার স্মৃতির স্মরণে সড়ক কিংবা যেকোন স্থাপনা নির্মানের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বোরহানউদ্দিন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আহম্মদ উল্যাহ জানান, চুন্নু মিয়া শুধু ভাষা সৈনিকই ছিলেননা, তিনি এখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু, দীর্ঘ দিনেও কেউ তার সম্মানে কোন স্থাপনা নির্মাণ করেনি। তিনি আরো বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর হলেও মরহুম ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজা-এ-করিম চৌধুরী ওরফে চুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এতে তার প্রতি যেমন মরনোত্তর সম্মাননা প্রদর্শন করা হবে, তেমনি আমরাও গৌরবান্বিত বোধ করবো।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মোঃ আঃ কুদ্দূস বলেন, একজন ভাষা সৈনিককে যথাযথ মূল্যায়ন করা আমাদের সকলেরই জাতীয় দায়িত্ব। কিন্তু এতদিন ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণে কেন কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তা আমার বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এগিয়ে আসতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ইউএনও আরো বলেন, গত বছর বোরহানউদ্দিনে প্রথম বই মেলার আয়োজন করেছি। ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্ম”তির স্মরনে সেই বই মেলা উৎসর্গ করা হয়েছে। এবারো ভাষা সৈনিকের স্মৃতির স্মরণে বই মেলা উৎসর্গ করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ২ ফেব্রুয়ারী বোরহানউদ্দিন উপজেলার আব্দুল জব্বার কলেজের অডিটরিয়ামে ভাষা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। স্বপ্নতরী নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ উৎসবের আয়োজন করে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ভাষা সৈনিকের স্ত্রী নুরজাহান বেগমের হাতে ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়াকে আজীবন মরনোত্তর সম্মাননা স্মারক তুলে দেন আয়োজনকারি সংগঠনের নেতৃববৃন্দ। এ ছাড়া গত ২৯ জানুয়ারী ঢাকার বিএম মিলনায়তনে ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরীকে মরনোত্তর সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়। বরিশাল বিভাগ সাংস্কৃতিক সংস্থা এ সম্মাননার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের হাত থেকে সম্মাননা স্মারক গ্রহন করেন মরহুম ভাষা সৈনিকের ছোট ছেলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
-এমএইচএম/এইচএমএন