বুধবার ● ৩০ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » জাতীয় » রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সামনে দুটি পথ খোলা
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সামনে দুটি পথ খোলা
ডেস্ক: মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে সশস্ত্র বাহিনীর নির্যাতনের মুখে কয়েক হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেই দেশটিকে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। চলতি আগস্টের শুরু থেকেই রাখাইনে সশ্রস্ত্র বাহিনীর অবরোধ শুরু হয়। গত কয়েকদিন ধরে তা সংঘর্ষে রূপ নিলে বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ফলে সীমান্তে কড়া অবস্থানের কথা বলে আসলেও মানবিক কারণে অনেককেই আশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ।
মানবাধিকারকর্মী, পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ক্রমাগতভাবে আশ্রয় দেওয়ার সামর্থ বাংলাদেশের নেই। আবার মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধও করতে পারে না।
ফলে মানবিক দিক বিবেচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ বিষয়ে সরব হতে হবে বাংলাদেশকে। কূটনৈতিকভাবে সফলতার সঙ্গে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারলে বছরের পর বছর বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যা বয়ে বেড়াতে হবে না বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশকে দুটি দিকে এগোতে হবে। প্রথমত: মানবিক অধিকার বিবেচনায় সীমান্ত বন্ধ করাটা ঠিক হবে না। কারণ আমরাও একসময় শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়েছি। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে শরণার্থীর একটি মৌলিক সম্পর্ক রয়েছে। সে জায়গা থেকে সরে যাওয়া ঠিক হবে না। এজন্য নারী ও শিশুদের নিরাপদ রাস্তা করে দেওয়াটা বাংলাদেশের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেলক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টা থাকা দরকার।’
দ্বিতীয়ত: আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করা জরুরি। তিনি বলেন, ‘কফি আনান কমিশন ইতিমধ্যে তাদের রিপোর্টে মিয়ানমার সরকারকে কী করতে হবে সেটি বলেছে। এ জায়গায় আমাদের সরকারের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটি ঢাকায় হতে হবে এমন নয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা অন্য যেকোনো শহরে হতে পারে।’
ড. ইমতিয়াজ বলেন, এই সম্মেলনে কফি আনানের রিপোর্ট কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে আলোচনা করতে হবে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেটি মিয়ানমার সরকারের উপর বাড়তি চাপ ফেলবে। এভাবে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে। এই দুই ধরনের পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি সমাধান হওয়ার সুযোগ থাকবে।
বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও সচিব নূর মোহাম্মদ। এর আগে মরক্কোতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা খুবই অমানবিক, এটি পৃথিবীর কেউই ভাল চোখে দেখবে না। কিন্তু এটি নিয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিটি সেভাবে সোচ্চার হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন দেশটি অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কারণে এমনটা হতে পারে। আবার দুই পাশে শক্তিধর দেশ চীন ও ভারত রয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থও আছে। অথচ তারা ভালো চাপ দিতে পারতো।’
বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্ট্যান্ডটা মানবিক কারণে, আবার ধর্মের মিলটাও কাজ করে। বছরের পর বছর আমরা ওদের থাকা, স্বাস্থ্য, খাবারের দিকটা দেখছি। কিন্তু আমরা তো নিজের ভারই বইতে পারছি না, সেখানে অন্যের ভার কতদিন কিভাবে সামলাবো? ওরা তো আসতেই থাকবে।’
বাংলাদেশকে কৌশলী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘আমরাও সেভাবে বিষয়টি সমাধান করতে পারছি না। এখানে কূটনৈতিক চ্যানেলে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘ, ভারত ও চীনসহ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভালোভাবে পদক্ষেপ নিতে পারলে এখানে ইতিবাচক ফল আসবে।’
তবে সাবেক সেনাপ্রধান ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদ বীরপ্রতীক মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও এর নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্ক সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেন, এটি ১৯৭৮ সাল থেকে রিপিট (পুনরাবৃত্তি) হচ্ছে, এমন অবারিতভাবে তো চলতে পারে না। এটি বন্ধ করতে হবে।
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমাদের এমনিতে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, যাদের মৌলিক চাহিদাই আমরা পূরণ করতে পারি না। এর উপর চার লাখ বিহারী রিফিউজি আমাদের ঘাড়ের উপর বসে আছে। আন্তর্জাতিক কোনো পক্ষ তার দায় নিচ্ছে না। এত চাপ নেওয়া তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি ছাড়াও বিপ্লবীরা ঢুকছে, তাদের সঙ্গে হাতিয়ারও আসার প্রমাণ মিলেছে। এসব কেবল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয় না, দেশেও পাচার হচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষার সঙ্গে কিছু মিল থাকার সুবিধা নিয়ে ওরা চট্টগ্রাম, উখিয়াসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দ্বার খুলে রাখব, আর তারা আসবে; কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা এর দায়িত্ব নিবে না- এটা কিভাবে? বড় প্রতিবেশী ভারতও নিচ্ছে না, সেখানে এককভাবে এত বড় জনগোষ্ঠির দায় নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।’
সরকারের করণীয় জানিয়ে হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, আন্তর্জাতিকভাবে এটি মোকাবেলা করতে হবে। সেজন্য শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতায় এটি আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা যে- আমাদের সমস্যা হচ্ছে, এর দায়িত্ব নিতে আমরা সমর্থ নই।’
মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানও প্রায় একই আবেদন জানিয়েছেন। ‘এখানে দুটো দিক। আমাদের জনসংখ্যা অনেক। নিজেদের বিভিন্ন ক্রাইসিস রয়েছে, এখনো বন্যা কাটিয়ে উঠিনি। আবার মানবিকতাও আছে, পাকিস্তান তো একই কাজ করেছিল আমাদের সঙ্গে। আর মানুষের জীবনটা সবার আগে, সেজন্য তাদের আশ্রয় দেওয়া জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘ওরা যেন নির্দিষ্ট এরিয়ার বাইরে না আসে, খাবার যেন পায়; সেজন্য জাতিসংঘসহ বাইরের দেশের সহযোগিতার পলিসি নিতে হবে।’
সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘দেশি-বিদেশি মিডিয়া ডেকে পরিস্থিতিটা দেখানো দরকার। কফি আনানের রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তবতার আলোকে বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেওয়া দরকার। বিশ্বকে জানানো দরকার যে- আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আরও হবে; এটি নিরসনে তোমরা ব্যবস্থা নাও।’
চলতি মাসের শুরুতে রাখাইনে সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার সরকার। ঘোষণা দেয় অভিযানের। এরই মধ্যে গ্রামের পর গ্রাম রোহিঙ্গাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর বদলা নিতেই রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ পোস্টে হামলা ও একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ হয়।
খোদ মিয়ানমার সরকারই জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মির (আরসা) আক্রমণের পর শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযানে’ প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের দাবি, নতুন করে আট শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে।
-পিডি