বৃহস্পতিবার ● ১০ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » জাতীয় » অনিশ্চয়তায় পড়ে কাঁদছেন অনেক হজযাত্রী
অনিশ্চয়তায় পড়ে কাঁদছেন অনেক হজযাত্রী
ডেস্ক: রংপুরের রফিকুল ইসলাম মণ্ডল হজ ক্যাম্পের এক পাশে বসে আছেন। কাছে গিয়ে লক্ষ করা গেল, তাঁর দুই চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের এই বৃদ্ধ বললেন, ‘আজ যাচ্ছি কাল যাচ্ছি বলে গত সপ্তাহ ধরে ক্যাম্পে অপেক্ষা করছি। আত্মীয়-স্বজনকে কয়েকবার বলেছি- সৌদি চলে যাচ্ছি। কিন্তু এজেন্সি মালিক ভিসা নিয়ে আসছে। তাই স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে বর্তমানে লজ্জা পাচ্ছি। এবার হজে যেতে পারব কি না জানি না। ’ ভিসা জটিলতার কারণে পর্যাপ্তসংখ্যক হজযাত্রী না পাওয়ায় একের পর এক ফ্লাইট যখন বাতিল হচ্ছে, অনেকে ভিসা পেয়েও যেতে পারছেন না এজেন্সিগুলোর কারণে। ২৬ আগস্ট হজ ফ্লাইট শেষ হচ্ছে। এখন প্রতিদিন দুই হাজার ২৭১ জনের বদলে গড়ে পাঁচ হাজার জনকেও যদি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়, ২৭ হাজার হজযাত্রী অনিশ্চয়তায় পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। গত মঙ্গলবার ধর্মমন্ত্রী হজ এজেন্সিগুলোকে দ্রুত হজযাত্রী পাঠানোর নির্দেশ দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি অনেক এজেন্সি।
গতকাল বেশ কয়েকটি হজ এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে। কয়েকজন এজেন্সি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা অনেক টাকা খরচ করে এই ব্যবসায় নেমেছেন। আগে পাঠালে পোষাবে না বলেই তাঁরা অপেক্ষা করছেন।
৩৭৭ হজ এজেন্সি যারা ভিসা পেয়েও যাত্রী পাঠাচ্ছে না, এমন একটি তালিকা পাওয়ার পর গতকাল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব গোলাম মাওলা যুগ্ম সচিব (হজ) বরাবর চিঠি দিয়েছেন। তালিকাভুক্ত এজেন্সিগুলোর মালিকদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সভা করে চলমান সমস্যা নিরসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার বা আগামীকাল শুক্রবার এই সভা হতে পারে বলে জানা যায়।
তালিকা সূত্রে জানা যায়, পুরানা পল্টনের এজেন্সি ইউরো এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলস এ বছর হজযাত্রী পেয়েছে ২৭৯ জন। ভিসা হয়েছে ২৬৪ জনের। কিন্তু একজন হজযাত্রীও পাঠায়নি প্রতিষ্ঠানটি। চট্টগ্রামের স্কাই ইন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের হজযাত্রী জোগাড় হয়েছে ২৩৮ জন। ভিসা হয়েছে ২২৯ জনের। এই এজেন্সিও কোনো হজযাত্রী পাঠায়নি। এভাবে ৩৭৭ হজ এজেন্সি গড়ে ১৫০ জন করে হজযাত্রী পাঠানোর সুযোগ পেলেও তাদের হাতে রয়েছে ৭৭ হাজারের ওপরে হজযাত্রী। এর মধ্যে ৫৬ হাজার ৫৫০ জন ভিসা নিয়েও হজে যেতে পারছে না। এজেন্সিগুলোর মধ্যে ৯৫টি কোনো হজযাত্রী পাঠায়নি। তাদের মাধ্যমে এবার ভিসা পেয়েছেন ১৮ হাজারেরও বেশি হজযাত্রী।
ইউরো এয়ার ট্রাভেলসের মালিক মাহমুদুর রহমান ২৫৭ জনের ভিসা পাওয়ার পরও কাউকে না পাঠানোর কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি ১৩ আগস্ট থেকে পাঠানো শুরু করবেন। তাঁর এজেন্সি হজের দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য সৌদি আরবে বাড়িভাড়া করায় তিনি এখন পাঠাচ্ছেন না বলে জানান। স্কাই ইন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক ইয়াসিন ২৩৮ জন হজযাত্রীর মধ্যে ২২৯ জনের ভিসা পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি একজনকেও ফ্লাইটে যেতে দেননি। তাঁর পরিকল্পনা ১৬ আগস্ট থেকে পাঠানোর। জানা গেছে, দেরিতে পাঠিয়ে কম সময় রাখতে পারলেই এজেন্সিগুলোর লাভ। এ জন্যই তাদের এ কৌশল।
গতকাল বুধবার আশকোনা হজ ক্যাম্পে হন্তদন্ত হয়ে ঘুরতে দেখা যায় নরসিংদীর এ কে ফজলুল হককে। তিনি সস্ত্রীক হজ পালনের জন্য একটি এজেন্সির হাতে ১০ লাখ টাকা তুলে দিলেও এখন পর্যন্ত মুয়াল্লিম এবং বাসা কিংবা হোটেল ঠিক হয়নি; যার কারণে ভিসা হাতে পাচ্ছেন না। কয়েক দিন ঘুরে এজেন্সি মালিককেও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। অফিসের লোকজন বলছে, মালিক বর্তমানে সৌদি অবস্থান করছেন। তিনি বাসা এবং মুয়াল্লিম ঠিক করে বাংলাদেশে ফিরে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দেবেন। ফজলুল হক শুনেছেন, ১৭ তারিখের মধ্যে ভিসার প্রক্রিয়া শেষ না হলে ফ্লাইট না-ও হতে পারে। এ কারণে তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন।
জানা যায়, ফকিরাপুলের সুপার খিদমাহ নামের একটি হজ এজেন্সি ২১২ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। এজেন্সির মালিকদের এক সপ্তাহ ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। নজরুল ইসলাম নামে প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রতিনিধি বলেন, তাঁরা মুয়াল্লিম এবং বাসা ঠিক করে ১৭ তারিখের মধ্যেই ভিসা প্রসেসিং করবেন।
হজ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এখনো অনেক এজেন্সি সৌদিতে মুয়াল্লিম এবং বাসাবাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। হজ এজেন্সির একাধিক কর্মচারী দাবি করেন, এবার মুয়াল্লিম ফি এবং বাসাভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ কারণেই অনেক এজেন্সি সংকটে পড়েছে। তারা লাভে ছাড় দিতে চাইছে না, আর ভিসার জন্য পাসপোর্টও জমা দেওয়া হচ্ছে না।
সহকারী হজ অফিসার মো. আবদুল মালেক বলেন, ‘হজযাত্রীদের প্রশ্নবাণে আমরা জর্জরিত। তাঁদের ধারণা, সব খবর আমাদের কাছে রয়েছে। অথচ আমরা পোস্ট অফিসের মতো দায়িত্ব পালন করে থাকি। মূলত প্রধান দায়িত্বগুলো তো পালন করে হজ এজেন্সিগুলো। বাড়িভাড়া, মুয়াল্লিম ঠিক করা থেকে শুরু করে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তারা করে থাকে। ’
এদিকে বাংলাদেশি হজ এজেন্সি মালিকদের ৯১ জন প্রতিনিধি সৌদি আরবে মুয়াল্লিম ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন গতকাল রাতে। তাঁরা অভিযোগ করেন, মুয়াল্লিম ফি বৃদ্ধি করে এবার এ গ্রেডে তিন হাজার ৯৫০, বি গ্রেডে এক হাজার ৯০০, সি গ্রেডে এক হাজার ৫০০ এবং ডি গ্রেডে ৭২০ টাকা করা হয়েছে। এর ফলে তাঁদের পক্ষে এত টাকা দিয়ে মুয়াল্লিম নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এ ফি বৃদ্ধির বিষয়টি তাঁদের কেউ আগে জানায়নি। এর ফলে প্রায় ১৮ হাজার হজযাত্রীর হজ করা অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। তবে তাঁদের এ ভাষ্য সৌদি কিংবা বাংলাদেশের কোনো প্রশাসন আমলে নেয়নি বলে জানা গেছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পাঠানো আশকোনা হজ ক্যাম্পের পরিচালক সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গতকালের হজ তথ্যসূত্রে জানা গেছে, গতকাল বাংলাদেশ বিমানে তিনটি ফ্লইটে এক হাজার ১৪২ জন এবং সৌদি এয়ারলাইনসের তিনটি ফ্লাইটে এক হাজার ১২৯ জন হজযাত্রী ফ্লাই করেছেন। গতকালও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের আরো দুটি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এ নিয়ে বিমানের মোট ১৯টি হজ ফ্লাইট বাতিল হয়। গতকাল বাতিল হওয়া বিজি-৫০৪৫ ফ্লাইটটি ভোর ৫টায় এবং বিজি-৩০৫৩ ফ্লাইটটি বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে সৌদি আরবের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ বলেন, ভিসা জটিলতার কারণে পর্যাপ্তসংখ্যক হজযাত্রী না পাওয়ায় ফ্লাইট দুটি বাতিল করা হয়েছে।
এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট হজযাত্রীর সংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ৪৯ হাজার ৬৮৪ জন হজযাত্রী সৌদি পৌঁছেছেন।