শুক্রবার ● ১২ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » জেলার খবর » বোরহানউদ্দিন মাদ্রাসা শেষ পর্ব: ‘বিশেষ ফ্লাইটে’ব্রিটেনে ফয়সাল,অন্যদের ওপর নির্মম নির্যাতন
বোরহানউদ্দিন মাদ্রাসা শেষ পর্ব: ‘বিশেষ ফ্লাইটে’ব্রিটেনে ফয়সাল,অন্যদের ওপর নির্মম নির্যাতন
আবু সুফিয়ান: দেশে হঠাৎ করেই জঙ্গিবাদের উত্থানে সরকার অনেকটাই বিব্রত। আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। সরকার বলছে,নাশকতায় দেশীয় জেএমবি জড়িত। তাদের দমনে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। জঙ্গিবাদের নেপথ্যের ক্রীড়নক নিয়ে চলছে চুলচেরা হিসাব-নিকাষ। জেএমবির বর্তমান নেতৃত্বের পেছনে কারা আছে তা হয়তো জানা যাবে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির পুরনো নেতৃত্বের সঙ্গে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এর সখ্যের তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির সঙ্গে এমআই-৬ এর একজন স্পেশাল এজেন্টের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ৬ পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভোলার সংবাদ ডট কমের পাঠকদের জন্য তা আবার প্রকাশ করা হলো-
‘স্যার আমি খুবই নিরীহ মানুষ। কাম কইরা যা পাই হাজিরায় খরচ হয়। জানি না ক্যান আমারে (র্যাব) শুধু শুধু ধইরা নিছে। আমি এইখানে আইছিলাম গোসল করতে। আমারে ধইরা নিয়া, রিমান্ডে নিয়া আজকে আমার জীবন তেজপাতা কইরা দিছে। আমার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়া রক্ত আসে এখনো। আমার কী অবস্থা! শইল্যের মধ্যে ছিনিমিনি করতাসে। কার দোষ দিমু?’
সরেজমিনে ভোলার রামকেশব গ্রামের বন্ধ ‘গ্রিন ক্রিসেন্ট মাদ্রাসা’য় গেলে সাংবাদিক আসার খবর শুনে ছুটে আসেন মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন (৩৩)। জঙ্গি মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছিল। গ্রেফতারের পর র্যাব হেফাজতে তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয় বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি।
লম্বাচওড়া গড়নের দিনমজুর জসিম। বাবার নাম আব্দুল জলিল। রামকেশব গ্রামের ৫নং সাচরা ইউনিয়নে তাদের বাড়ি।
গ্রামের সহজ-সরল এই দিনমজুর গ্রিন ক্রিসেন্টের পুকুরে গোসল করতে এসেছিলেন। এসেই ফেঁসে গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। পরে জঙ্গি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় র্যাব। এখনো র্যাবের নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
প্রস্রাবের রাস্তায় রক্ত আসে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জসিম বললেন, ‘পায়ের তলায় অনেক মাইরধর দিছে স্যার। অনেক মারছে আমারে স্যার। র্যাবে চোখ বাইন্দ্যা কৈ নিছে জানি না। পায়ের তলায় অনেক মারছে। অনেক নির্যাতন করছে স্যার। এয়া বলতে পারমু না। আমার গায়ে ঘাও হইয়া গ্যাছে।’
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা ভোলা। এর আয়তন ৩৭৩৭.২১ বর্গকিলোমিটার। ভোলার উত্তরে লক্ষ্মীপুর ও বরিশাল। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পূর্বে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, মেঘনা নদী ও শাহবাজপুর চ্যানেল। পশ্চিমে পটুয়াখালী, বরিশাল জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী।
জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ছোট উপজেলা বোরহানউদ্দীন (২৮৪.৬৭ বর্গকিলোমিটার)। এই উপজেলারই প্রত্যন্ত ৫নং সাচরা ইউনিয়নের রামকেশব গ্রাম। এখানকার বেশীরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। এই ইউনিয়নেই গড়ে উঠেছিল গ্রিন ক্রিসেন্ট মাদ্রাসা। গ্রামের মানুষ আজও বিশ্বাস করেন না— এখানে গভীর রাতে চলত ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণ’।
সেই ‘জঙ্গি ঘাঁটি’র অন্য আসামিদের খবরাখবর নিতে ঢাকা থেকে পৌঁছাই ভোলা সদরে। ভোর থেকেই একনাগাড়ে মুষলধারে বৃষ্টি। দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের স্থানীয় প্রতিবেদক জুয়েল সাহা বিকাশ জানালেন বৃষ্টি না কমলে সেই গ্রামে যাওয়া কঠিন। পথঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। বেরিয়ে পড়লাম তার কথা না শুনে। ৩০ মিনিটের বাস যাত্রায় গিয়ে পৌঁছলাম বোরহানউদ্দীনে। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত রিকশায় গেলাম সাচরা ইউনিয়নে।
চারদিকে সরু খাল দিয়ে ‘পরিখা’। বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে সান্ত্রীর মতো। দূর থেকেই চোখে পড়ে লাল ভবনটি। একতলা। বেশ গোছানো। ঢুকতেই লোহার পাটাতন, যা নাকি রিমোটে ওঠানামা হতো। ঢুকে পড়লাম ‘গ্রিন ক্রিসেন্ট মাদ্রাসা’য়। আমাদের দেখে ছুটে এলেন কেয়ারটেকার মো. আব্দুল আলী। কয়েক বছর পর আবারও সেখানে সাংবাদিক যাওয়ায় বেশ অবাক হলেন।
আব্দুল আলী মানতে নারাজ এখানে জঙ্গি ঘাঁটি ছিল। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ র্যাবের লোকজন এসে বলল, এটা জঙ্গি ঘাঁটি। তারপর এলাকার লোকজন ও মিস্ত্রিদের ধরে নিয়ে গেল।’
‘র্যাব পুকুরে জাল ফালাইয়া অস্ত্র খুঁজছে। পায় নাই। কয়েক মণ মাছ পাইছে। হেইগুলান (মাছ) নিয়া গ্যাছে।’ বলেন আলী।
তথাকথিত সেই জঙ্গি ঘাঁটিতে অভিযানের পর ১২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়, যার বেশীরভাগই বোরহানউদ্দীন ও দৌলতখানের মুটে-মজুর।
এখন সেই পরিত্যক্ত মাদ্রাসাটিতেই থাকেন আব্দুল আলী। আদালতের নির্দেশেই দেখভাল করেন।
মাদ্রাসাটি ঘুরে ঘুরে দেখাতে দেখাতে আলী বলেন, ‘জংলি (জঙ্গি) কৈ? এইসব বানান কথা। পিচ্চি পিচ্চি ৭-৮ জন পোলাপাইন জংলি? এইসব মানুষ বিশ্বাস করব? ওরা (র্যাব) বানাইছে এইসব কথা।’
এত বছর পর গ্রিন ক্রিসেন্টে সাংবাদিকদের উপস্থিতির খবরটা চাউর হতে বেশী সময় লাগেনি। খবর পেয়ে হাজির হন মামলার এক নম্বর সাক্ষী মো. জামাল মৃধা।
সত্তর বছর পেরোনো জামাল মৃধাও দাবি করেন, বিনা কারণেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের ধরে নিয়ে আসামি করা হয়েছে।
‘সব ভুয়া। তারা (র্যাব) সবাইরে ফাঁসাইছে।’ মন্তব্য করেন জামাল মৃধা।
মামলার আসামিদের মধ্যে ড. ফয়সাল জামিন নিয়ে ব্রিটেনে চলে গেছেন। অন্য আসামিদের কেউ ভোলাতেই বসবাস করছেন। কেউবা চলে গেছেন নোয়াখালীতে।
রামকেশব গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দৌলতখান উপজেলায় গিয়ে পাওয়া গেল মামলার আরেক আসামি মোহাম্মদ বাদলকে (৪০)। পেশায় তিনি একজন ঠিকাদার। গ্রিন ক্রিসেন্ট ‘মাদ্রাসা’য় ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।
বাদল বলেন, ‘আমরা ছিলাম ঢাকার বাইরে। আমি ওইখানে কাজ (ঠিকাদার) করছিলাম। গ্রেফতারের পর র্যাব হেডকোয়ার্টারে নিয়া গেছে।’
(র্যাব কি) মারধর করেছে?
হেসে জবাব দিলেন, ‘এইটা কইয়া লাভ আছে? বুঝেন-ই তো!’
মামলার অন্য আসামিরা কোথায়?
‘আছে। মেস্তরি-টেস্তরিরা আছে।’
মামলায় কেমন খরচ হয়েছে?
‘সাত-আট লাখ টাকা।’
বাদল আর কোনো কথা বলতে রাজী হননি। র্যাব হেফাজত সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের পরও তিনি চুপ থেকেছেন অথবা হেসে মাথা নিচু করে রাখেন।
বাদল জানান, মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে লন্ডন চলে গেছেন মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল।
মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট শাজাহান বলেন, ‘মামলাটি এখন ভোলার এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জজ আদালতে বিচারাধীন। মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য চলছে।’
শাজাহান আরও বলেন, ‘মামলার সব আসামি জামিনে রয়েছেন। ড. মোস্তফা ফয়সাল উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।’
ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এর জনসংখ্যা অনেক আগে ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে বিভিন্ন সময় জঙ্গি ঘাঁটির সন্ধান পাওয়ার দাবি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলাও করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশও হয়। অনেকেই গ্রেফতার হন, অনেকেই ছাড়া পান। কিন্তু নেপথ্যের ক্রীড়নকদের অনেকেই ধরা পড়েন না। যারাও বা ধরা পড়েন, জামিন নিয়ে নিরাপদেই চলে যান। যেমনটা নিরাপদে চলে গেছেন ড. মোস্তফা ফয়সাল, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এজেন্ট।
বোরহানউদ্দিনের গ্রিন ক্রিসেন্ট মাদ্রাসায় অস্ত্র উদ্ধার অনুসন্ধান-১ : জেএমবির সঙ্গে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার পুরনো সখ্য
সূত্র: দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডট কম