বুধবার ● ১০ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » জেলার খবর » রোবহানউদ্দিন মাদ্রাসা অনুসন্ধান-৪: দাতব্যের আড়ালে ব্রিটিশ এজেন্টের ‘অন্য মিশন’
রোবহানউদ্দিন মাদ্রাসা অনুসন্ধান-৪: দাতব্যের আড়ালে ব্রিটিশ এজেন্টের ‘অন্য মিশন’
আবু সুফিয়ান: জেএমবির সঙ্গে সখ্য গড়তে ও তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ড. ফয়সাল। ভোলা ছাড়াও, দাউদকান্দি, দিনাজপুর ও হবিগঞ্জে গড়ে তোলেন মাদ্রাসা, দাতব্য হাসপাতাল। এসব স্থাপন করতে অপ্রকাশ্য লেনদেনের কথা প্রকাশ না করলেও, প্রকাশ্য লেনদেনের তথ্য জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তার বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থেই এসব দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা জানান তিনি। কিন্তু, এসবের পেছনে ছিল ডা. ফয়সালের অন্য মিশন। তবে পুরো মিশন বাস্তবায়নে আগেই ধরা পড়েন তিনি।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে ছাড়া পান ড. ফয়সাল। জামিনে ছাড়া পেয়েই ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহায়তায় তিনি ব্রিটেনে চলে যান।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে যুক্তরাজ্যে চলে গেছেন তিনি। কেউ কেউ বলছেন, এমআই-৬ একটি বিশেষ ফ্লাইটে নিয়ে গেছে তাকে। পরিষ্কার কিছুই জানেন না কেউ।
ফয়সাল গ্রেফতারের পর ব্রিটেনের ডেইলি মেইল পত্রিকা ও বিবিসির খবরে বলা হয়, বোমা হামলা পরিকল্পনার একটি মামলা থেকে ম্যানচেস্টারের ক্রাউন কোর্ট আদালত ড. ফয়সাল মোস্তফাকে ২০০২ সালে খালাস দেয়।
বিবিসির ওই সময়কার খবরে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশগামী একটি ফ্লাইটে পিস্তল ও গুলিসহ ওঠার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হন তিনি। পরে ছাড়াও পান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিক।
ভোলায় এতকিছু হলেও ফয়সালের খবর কেউ জানেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তার পুরো নাম ফয়সাল মোস্তফা। ১৯৬৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভোলা জেলায় তার জন্ম। বাবার নাম গোলাম মোস্তফা। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে বসবাস করতেন। ঠিকানা— ৬২, গ্রিন পাস্তুর, স্টকপোর্ট।
গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল জানান, দেশে বেড়াতে এলে তিনি দাউদখানে তার খালার বাসায় উঠতেন। তিন সন্তানের জনক ফয়সালের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
নিজেকে ‘পরামর্শক’ ও ‘স্ব-উদ্যোক্তা’ দাবি করেন তিনি।
গোয়েন্দাদের ফয়সাল বলেন, ‘রাসায়নিক পদার্থ আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কোম্পানিগুলোকে পরামর্শ দিয়ে থাকি। পদার্থের যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, বাজারদর, ব্যবহার এবং সেগুলো কীভাবে খালাস হবে— এ সংক্রান্ত পরামর্শ দিই।’
ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন ফয়সাল। সেখান থেকে রসায়নে সন্মান এবং অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। নর্থ পেট্রো কেম ও শেলের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল জানান, বছরে একবার আবার কখনো দু’বারও বাংলাদেশে আসতেন।
‘গ্রিনক্রিসেন্ট’প্রতিষ্ঠা
২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশে ‘গ্রিন ক্রিসেন্ট’ নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এর সদর দফতর বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ ম্যানচেস্টারের স্ককপোর্ট শহরে।
এখানে একটি হাসপাতাল বানিয়ে দুস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। ১২ একর জায়গাজুড়ে সেখানে ছিল একটি এতিমখানা। ওই স্কুলে গণিত, বিজ্ঞান, আরবি শিক্ষাসহ ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তা আর বস্তাবায়িত হয়নি। এ ছাড়াও কাঠের কাজ, মেশিনের কাজ, মাছ চাষ ও শাকসবজির চাষ শেখানোর কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল।
ফয়সাল জানান, এটি একটি দাতব্য সংস্থা, যার যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে সনদ রয়েছে। এর অনুদান আসে ব্যক্তিপর্যায় থেকে। সরকার থেকে এটিতে কোনো অনুদান দেওয়া হয় না।
সেবা সংস্থাটি সম্পর্কে গোয়েন্দাদের সঙ্গে ফয়সালের জিজ্ঞাসাবাদ হুবহু তুলে ধরা হল—
ব্যক্তিগত অনুদান আসে কোথা থেকে?
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে।
সেই অনুদান কে সংগ্রহ করেন?
আমি-ই সাধারণত সেটি করি। কখনো অন্যরাও করেন।
কারা, তাদের পরিচয়?
একজন হলেন মিস্টার সুবানি। তিনি টাকা তুলতে সাহায্য করেন। অন্য আরেকজন সিস্টার ডিলারি। সিস্টার ডলারি আমার স্ত্রীর বান্ধবী।
এই দু’জন কোথায় থাকেন?
মিস্টার সুবানি থাকেন লং সাইড, রোড নাম্বার ৭৪। সিস্টার থাকেন ৬৯… আমি আর জানি না।
গ্রিনক্রিসেন্টের কয়টি শাখা রয়েছে?
আসলে আমাদের শাখা অফিস নেই। সাধারণত যে কোনো বাড়ির কামরা অফিস হিসেবে ব্যবহার করি আমরা। একটা অফিস আছে দুধখোলায়, হাসপাতালের ভেতরে।
হাসপাতালের ভেতরে! এধরনের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির পেছনে কারণ কী?
কারণ হল পশ্চিমের মানুষের অনেক টাকা। কিন্তু তারা জানে না এত টাকা দিয়ে কী করবে? তাই আমি ভেবেছিলাম এই টাকা দিয়ে যদি বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যায়, তাহলে মানুষ উপকৃত হবে।
এ সব প্রতিষ্ঠানের জায়গা কোথায়?
হাসপাতালটা দাউদখানে, সেটার জমিটা বিনামূল্যে এসেছে। ৬০০০ পাউন্ড খরচ করে আমরা হবিগঞ্জে কিছু জায়গা কিনেছি। দিনাজপুরেও মেয়েদের স্কুলের জন্য জায়গা কেনার ইচ্ছা আছে আমাদের।
এখন পর্যন্ত দেশে কত টাকা খরচ করেছেন আপনি?
প্রায় ৭০ হাজার পাউন্ড, যেটা টাকার হিসাবে ৮০ লাখ টাকার মতো। সবটাই বড় প্রজেক্ট স্কুলের পেছনে।
এই প্রকল্পে আপনার ব্যক্তিগত দানের পরিমাণ কত?
আমি নিজে প্রায় ১২ হাজার পাউন্ড মানে ১৪ লাখ টাকার মতো অনুদান দিয়েছি।
আপনার নিজের আয় থেকে?
হ্যাঁ, এ জন্য আমি আমার ও আমার স্ত্রীর শেয়ার বিক্রি করেছি।
এখানে আপনার সঙ্গে গ্রিনক্রিসেন্টে আর কে কে আছেন? মানে বাংলাদেশে কারা কাজ করেন?
হুমায়ুন আর আলম দাউদকান্দিতে ক্লিনিক দেখাশোনা করে। ব্রাদার মঞ্জুর হবিগঞ্জ এলাকায় হাসপাতালের কাজ এবং কোরবানি-ইফতারের মতো সামাজিক বিষয়গুলো সামলাচ্ছে। আরও কিছু লোকজন আছে। অনুসন্ধানি ধারাবাহিক বাকি রিপোর্ট গুলো জানতে চোখ রাখুন ভোলার সংবাদ ডট কমে।
বোরহানউদ্দিন মাদ্রাসা অনুসন্ধান-৫: ‘মস্তিষ্কশূন্য’ জেএমবি মিলিটারি গ্রেডের বিস্ফোরক তৈরিতে আগ্রহী
সূত্র: দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডট কম