শিরোনাম:
●   ভোলার কর্ণফুলী-৩ লঞ্চে চাঁদপুরের মোহনায় অগ্নিকাণ্ড ●   উদ্ভাস-উন্মেষ-উত্তরণ এখন দ্বীপ জেলা ভোলায় ●   ভোলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আ’লীগের সমর্থিত প্রার্থী বশীর উল্লাহ সভাপতি, সম্পাদক মাহাবুবুল হক লিটু নির্বাচিত ●   ভোলা জেলা প্রশাসকের সাথে আইনজীবী সমিতির মতবিনিময় ●   চরফ্যাশনে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়লো চট্টগ্রামগামী বাস ●   ডয়েসে ভ্যালী ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনিস্টিটিউটের যৌথ আয়োজনে প্রিন্ট পত্রিকার সম্পাদকদের কর্মশালা সম্পন্ন ●   ভোলায় চারটি সহ সারাদেশে ১৫০ সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ●   ভোলায় ৩৩৫ কোটি টাকার শহর রক্ষা বাঁধ এখন মরণ ফাঁদ! ●   ভোলায় জমি দখলের খবর পেয়ে স্ট্রোক করে মারা গেলেন প্রবাসী ●   ভোলার নবাগত জেলা প্রশাসকের সাথে আইনজীবী সমিতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
ভোলা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভোলার সংবাদ
শনিবার ● ১৮ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » শুধু ফুটবল খেললে আমার ধারেকাছে কেউ থাকত না
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » শুধু ফুটবল খেললে আমার ধারেকাছে কেউ থাকত না
৬০৮ বার পঠিত
শনিবার ● ১৮ জুন ২০১৬
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

শুধু ফুটবল খেললে আমার ধারেকাছে কেউ থাকত না

 ---

ডেস্ক: নাম শুনলে রাজনীতিক বা মন্ত্রীর চেহারাই ভেসে ওঠে এখন। অতীতের কথা মনে করতে গেলেও আগে আসে রণাঙ্গনের তুখোড় মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়। অথচ কাগজ-কলমে তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসেরই সেরা ফুটবলার। ফুটবলার পরিচয় প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই কিংবদন্তি মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। ফুটবল অঙ্গনের ধারণা তিনি রাশভারী স্বভাবের মানুষ। কিন্তু যখন ফিরে গেলেন পুরনো দিনে, তখন সোনালি স্মৃতির নেশায় খুলে গেল অর্গল। স্বপ্নের রং নিয়ে নিজের কীর্তির সঙ্গে উঠে এলো সেই সময়ের ফুটবল-বাংলাদেশসহ আরো অনেক কিছু
প্রশ্ন : রাজনীতিবিদ পরিচয়ের আড়ালে আপনার ফুটবলার পরিচয় একরকম হারিয়েই গিয়েছে। এটি আপনার কতটা আক্ষেপের জায়গা—তা দিয়েই কথোপকথন শুরু করতে চাই।

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম : এটি আমার খুবই দুঃখের জায়গা। ৭২ বছরের এই জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করি, আমি মুক্তিযোদ্ধা। যশোর ক্যান্টনমেন্টে ৫০-৬০ জন বাঙালি অফিসার ছিলেন। একজনই শুধু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, সেটি আমি। সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ করে যুদ্ধে গিয়েছি, ৯ মাস জীবন হাতে রেখে যুদ্ধ করেছি, আহত হয়েছি, নতুন এক দেশ উপহার দিয়েছি—এর চেয়ে বড় গর্ব আর হতে পারে না। এর পরপরই ফুটবলের অর্জন। শেষে রাজনীতি। কী দুর্ভাগ্য, সবচেয়ে কম পছন্দ করি যে রাজনীতি, সেটিই এখন আমার পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফুটবলার হাফিজের কথা পুরনো দিনের মানুষ ছাড়া কারো মনে নেই।

প্রশ্ন : তারপরও আপনার অনেক ফুটবলীয় কীর্তি এখনো স্মরণীয়। ঢাকার মাঠে প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিকটি যেমন। সেই ম্যাচের একটু স্মৃতিচারণ যদি করতেন?

হাফিজ : এটি ১৯৭৩ সালের লিগে, ফায়ার সার্ভিসের বিপক্ষে। মোহামেডান তখন দুর্বল দল। আমি ছাড়া তেমন ভালো ফুটবলার নেই। তখন সংবাদপত্রে প্রায় শিরোনাম থাকত, ‘হাফিজের এক গোল, তাতেই মোহামেডান জিতল।’ ডাবল হ্যাটট্রিকের ম্যাচটিতে মজার ঘটনা আছে। ফায়ার সার্ভিস ঢাকার মাঠে আমার প্রথম ক্লাব। ওদের প্রতি একধরনের দুর্বলতা তাই ছিল। আমার বিপক্ষে সেদিন ফুলব্যাক খেলছে পুরনো সতীর্থ দুলাল। প্রথম গোল দিলাম, দ্বিতীয় গোলও। এরপর দুলাল এসে বলে, ‘হাফিজ ভাই, হইছে তো। দুই গোল দিছেন, আর দিয়েন না।’ কিন্তু ভাবলাম হ্যাটট্রিক তো করা দরকার। করলাম। এরপর আবার দুলাল বলে, ‘হাফিজ ভাই, হ্যাটট্রিক হয়ে গেছে। আর গোল দিয়েন না।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, দেব না।’ গোল যেন না করতে হয়, তাই বক্সের ভেতরে যাই না। মোহামেডানের রাইট আউট সুরুজ একটি লব করল। বল নামিয়ে ভেতরে ঢুকে গোল করতে পারি। কিন্তু যেহেতু পুরনো ক্লাবকে আর গোল দেব না ভেবেছি, তাই ওই বক্সের বাইরে থেকে মারলাম ভলি। সেটিও গোল! এরপর আমিই দুলালের কাছে গিয়ে বললাম, ‘কী করব, এটি তো গোল হবে ভাবিনি।’ ও বলল, ‘আচ্ছা, আর দিয়েন না।’ কিছুক্ষণ পর বল এমন পজিশনে আমার পায়ে এলো, গোল না দিয়ে উপায় নেই। তখন মনে হলো, ডাবল হ্যাটট্রিকের চেষ্টা করি। সেই চেষ্টা করে দিলাম শেষ গোল। স্বাধীন দেশে প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিক আমার, সেটি তো অবশ্যই গর্বের। কিন্তু তা এখন জানেন কতজন?
প্রশ্ন : আবাহনীর বিপক্ষে ১৯৭৫ সালে মোহামেডানের ৪-০ ব্যবধানে জয়েও তো আপনার গোল রয়েছে…

হাফিজ : সেটি এক অসাধারণ ম্যাচ। আমরা যা চাইছিলাম, তা-ই করতে পেরেছি। ওরা হতভম্ব হয়ে যায় পুরোপুরি। মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে কোনো দল চার গোলে জিতবে, তখনকার প্রেক্ষাপটে সেটি ছিল অসম্ভব। আর আমি যে গোল করেছি, ঢাকার মাঠে সেটি আমার সেরা গোল। আমাদের হাফ থেকে বল নিয়ে শুরু করেছি দৌড়। আবাহনীর দুজন আমার পেছনে। আমি বল পায়ে দৌড়াচ্ছি, ওরা শুধু শুধু। তবু আমাকে ধরতে পারেনি। গোলরক্ষকের সামনে গিয়ে ওর মাথার ওপর দিয়ে চিপ করে গোল করেছি।

প্রশ্ন : ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর আপনি নাকি আবাহনীর বিপক্ষে গোল করেছিলেন। এটি সত্যি?

হাফিজ : ঠিক সাল ধরে ধরে মনে নেই। তবে এই রেকর্ড মনে আছে, আবাহনীর বিপক্ষে ১০ ম্যাচে আমার ৭ গোল। তাহলে টানা পাঁচ মৌসুমে গোল থাকারই কথা। আসলে শেখ কামাল আমাকে জাতীয় দলে নেয় না বলে ওদের বিপক্ষে খেলার সময় একটা জিদ কাজ করত। সে কারণেই হয়তো এত গোল করেছি। আরেকটি ব্যাপার। বড় খেলোয়াড় আপনি বিচার করবেন বড় ম্যাচের পারফরম্যান্স দিয়ে। আবাহনীর বিপক্ষে আমি সব সময় ভালো খেলেছি। ১৯৭৬ সালের লিগের সেমিফাইনালে বিজেএমসির বিপক্ষে মোহামেডানের তিন গোলের জয়ে আমার হ্যাটট্রিক। ফাইনালে আবাহনীর বিপক্ষে দুই গোল। অধিনায়ক হয়ে, সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে চ্যাম্পিয়ন করাই মোহামেডানকে।

প্রশ্ন : শেখ কামাল জাতীয় দলে আপনাকে নেয়নি বলছিলেন। পাকিস্তান জাতীয় দলে তো আপনি বেশ কিছু দিন খেলেছেন?

হাফিজ : চার বছর। ১৯৬৭ সালে প্রথম সুযোগ পাওয়ার পর থেকে নিয়মিত। বাঙালিদের মধ্যে অন্যরা এক টুর্নামেন্টে সুযোগ পেলে অন্যটিতে হয়তো পেত না। আমিই একমাত্র বাঙালি ফুটবলার যে ধারাবাহিকভাবে খেলেছি পাকিস্তান দলে। আর যুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় দল সর্বশেষ যে ম্যাচ খেলে ইরানে, সেই দলে আমি তো অধিনায়ক। সহ-অধিনায়ক ছিলাম শুরুতে, অধিনায়ক আহত হওয়ার পর আমিই দিই নেতৃত্ব। ১৯৭১ সালের আগে সর্বশেষ ম্যাচে আমি পুরো পাকিস্তান দলের অধিনায়ক। অথচ যুদ্ধের পর প্রথম যে বাংলাদেশ দল হলো ১৯৭৩ সালের মারদেকা ট্রফির জন্য, সেখানে আমার নামই নেই! ফর্মে ছিলাম না? দল যখন ঘোষণা করা হয়, তখন লিগের দুই ম্যাচে আমার ৭ গোল। ওই ডাবল হ্যাটট্রিকসহ। তবু ডাকা হয়নি জাতীয় দলে।

প্রশ্ন : শেখ কামাল নাকি আপনাকে আবাহনীতে খেলার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর আপনি সেটি গ্রহণ করেননি বলেই সেটি হয়েছিল?

হাফিজ : না, ঘটনা অন্য রকম। শেখ কামাল আবাহনীতে খেলার প্রস্তাব আমাকে কখনো দেননি। জানতেন যে, দিলেও যাব না। মূল ঘটনা হলো, আমার বাবা আজহার উদ্দিন আহমদ ’৭৩-র নির্বাচনে জাসদ থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। উনি ’৬২, ’৬৫, ’৭০ সালে তিনবারের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে। পরে দল থেকে বেরিয়ে যান আরো অনেকের সঙ্গে। জাসদের প্রথম কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ’৭৩-এর নির্বাচনে প্রাথী হন জাসদ থেকে। বাবা এত জনপ্রিয় ছিলেন যে ভোলায় তাঁর আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন আওয়ামী লীগের লোকজন আমার বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। ফলে তিনি তা জমা দিতে পারেননি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেলেন শেখ মুজিব। কিন্তু ওই যে তাঁর বিপক্ষে নির্বাচনে দাঁড়ালেন বাবা, সেটি হয়ে গেল আমারও দোষ। ’৭৩-এর মারদেকার দলটি তৈরি করেছিলেন মূলত শেখ কামাল। আমাকে তাই সেখানে ডাকা হয়নি। আর কখনোই না। পুরো পাকিস্তান ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলাম আমি, অথচ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার পর বাংলাদেশ জাতীয় দলে আমাকে কখনোই ডাকা হয়নি। এই দুঃখ কি কোনো দিন ভোলা যাবে?

প্রশ্ন : ফুটবলের শুরু একটু জানতে চাই। খেলাটির প্রতি আগ্রহ হলো কিভাবে?

হাফিজ : দেলোয়ার নামে আমার এক চাচাতো ভাই ছিল। সে ফুটবল খেলত বরিশাল মোহামেডানে। তাকে সাদা-কালো জার্সি পরে দেখে দেখে খেলার প্রতি ঝোঁক হয়ে যায়। বরিশাল লিগে শুরু করি খেলা। কিন্তু বাসা থেকে উৎসাহ দেওয়া হতো না মোটেই। ফুটবল খেলার জন্য আব্বার হাতে মার খেয়েছি অনেক। মা করিমুন্নেসা বাসা সামলাতেন। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। আব্বা চেয়েছিলেন আমাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। নিদেনপক্ষে যেন সিএসএস পরীক্ষা দিই। ১৯৬৭ সালে যেদিন সিএসএস পরীক্ষা, সেদিন আমি প্লেনে করে চলে গেলাম জাতীয় দলের হয়ে বার্মায়। আব্বার জীবনে সবচেয়ে বড় দুঃখ ছিল এটি। পরে তাঁকে খুশি করার জন্য ’৬৮ সালে যোগ দিই সেনাবাহিনীতে।

প্রশ্ন : ঢাকার ক্লাব ফুটবলে এলেন কিভাবে?

হাফিজ : এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে খেলার বড় ভূমিকা। তারও আগে যখন কলেজে পড়ি, কোচ সাহেব আলী ভাই বরিশাল লিগে আমার খেলা দেখেছিলেন। আসতে বলেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু যেদিন রওনা দেব, সেদিন নদীতে বিপদ সংকেতের কারণে স্টিমার ছাড়েনি। ঢাকা লিগে খেলা আর হলো না। ১৯৬১ সালে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই দলের তুখোড় ফুটবলার আপনাদের সাংবাদিক কামরুজ্জামান ভাই। আন্তবিভাগের এক খেলায় আমাদের ১০ জন ফুটবলার এসেছে, আরেকজন আসেনি। জামান ভাই তখন আমাকে নেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু কেউ খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিল না। রাগ হলো। প্রথম ১০ মিনিটেই দিলাম চার গোল। এখানে মজার একটি তথ্য দিই। আমাদের সেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান দল থেকে চারজন পরে মন্ত্রী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের আবদুর রাজ্জাক, জাতীয় পার্টির সাত্তার, বিএনপি থেকে আমি আর নাজমুল হুদা। যাহোক, পরের ম্যাচগুলোতেও গোল পেলাম। সাহেব আলী ভাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের কোচ। আবার ঢাকা লিগে ফায়ার সার্ভিসেরও কোচ। উনি তখন আমাকে ঢাকা লিগে নিয়ে যান।

প্রশ্ন : মোহামেডানে এলেন কবে?

হাফিজ : ১৯৬২ সালে ফায়ার সার্ভিস, পরের বছর ওয়ারীতে, এরপর ফিরি আবার ফায়ার সার্ভিসে। ’৬৪ সালে লিগে আমাদের অবস্থান ছয়-সাত নম্বরে। ১৯৬৫ সালে হই চতুর্থ, জামান ভাই ছিলেন সেই দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড। ১৯৬৬ সালে যাই ওয়ান্ডারার্সে, হলাম রানার্স-আপ। ’৬৭ সালে অবশেষে স্বপ্নের ক্লাব মোহামেডানে। একবার ওই সাদা-কালো জার্সি পরার পর তা কখনো বদলাইনি। আর ওই ’৬৭ থেকেই শুরু পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলা।

প্রশ্ন : বাঙালিদের জন্য তখন তো এটি অনেক বড় ব্যাপার, তাই না?

হাফিজ : হ্যাঁ, অনেক বড়। একটু বুঝিয়ে বলি। পাকিস্তান দল করার সময় প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৪ জন ফুটবলার ডাকে; প্রতি পজিশনে চারজন করে। এর মধ্যে বাঙালি থাকে তিন-চারজন, তাদের মধ্যে এক-দুজন সুযোগ পায় মূল স্কোয়াডে। ১৯৭০ সালের সর্বশেষ দলটিতে ছিলাম আমরা তিনজন—আমি, জাকারিয়া পিন্টু ও নুরুন্নবী। আন্তর্জাতিক ফুটবলার এই তিনজন। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একসঙ্গে ১৮ জন বাঙালি হয়ে গেল আন্তর্জাতিক ফুটবলার। তিন থেকে ১৮। সেখানে যারা সুযোগ পেল, তাদের নাম কেউ জানত না। আমিও জানতাম না। স্বাধীনতার পর দেখা গেল মিডফিল্ডে সেরা খেলোয়াড় অমলেশ, ওকে আগে আমরা চিনতামই না। সালাউদ্দিন তো ’৭০-এর মোহামেডান দলেও ছিল রিজার্ভ ফুটবলার। পাকিস্তান আমলে অমন পরিস্থিতিতে বাঙালি হিসেবে জাতীয় দলে খেলা সত্যি খুব বড় ব্যাপার ছিল।

প্রশ্ন : স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলেননি আপনি। সেটি কি যুদ্ধের ময়দানে থাকার কারণে?

হাফিজ : হ্যাঁ, আমাকে খবর দিয়েছিল। কিন্তু আমি আর্মির লোক, দেশে যুদ্ধ চলছে। এমন অবস্থায় ফুটবল মাঠের চেয়ে যুদ্ধের ময়দানেই আমাকে বেশি প্রয়োজন দেশের। যে কারণে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যাওয়া হয়নি। আমি ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে বেনাপোল অঞ্চলে যুদ্ধ করেছি। পরে জেড ফোর্সের অধীনে সিলেট অঞ্চলে। কামালপুর অভিযানে মর্টারের শেল লেগেছিল আমার শরীরের পাঁচ জায়গায়। আমি যে কেমন যোদ্ধা ছিলাম, মাঠের যোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। যুদ্ধ চলাকালে মাত্র ছয়জনকে বীরত্বের জন্য প্রতীক দেওয়ার ঘোষণা হয়। আমি তাঁদের একজন।

প্রশ্ন : ১৯৭২ সালে চালু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লিগ। সেটি মাঝপথে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল কেন?

হাফিজ : তখন লিগের মাতবর আজাদ স্পোর্টিংয়ের আনিসুর রহমান। যখন বুঝল যে আজাদ রেলিগেশনে পড়ে যাবে—তখন লিগ বন্ধ করে দেয়।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা লিগে মাকরানী খেলোয়াড় আসা বন্ধ হলো। ভিক্টোরিয়া-ওয়ান্ডারার্সের মতো দলগুলো দুর্বল হয়ে গেল তাই। তবু মোহামেডানের আবার চ্যাম্পিয়ন হতে লেগে যায় কয়েক মৌসুম। কারণটা কী বলে আপনার মনে হয়?

হাফিজ : একটা কারণ, টিপু ভাই, নান্নুর মতো ভালো ভালো ফুটবলার আবাহনী নিয়ে যায় মোহামেডান থেকে। এ ছাড়া আমরা ভালো দল গড়তে পারছিলাম না। ১৯৭৫ সালে ওদের ৪-০ গোলে হারানোর মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হই আবার। পরের বছর অধিনায়ক হিসেবে আবার চ্যাম্পিয়ন।

প্রশ্ন : আপনি যে সেনাবাহিনী থেকে এসে ফুটবল খেলতেন—এতে অসুবিধা হতো না?

হাফিজ : তা তো হতই। বিশেষ অনুমতি নিয়ে খেলেছি। একটা কথা বলতে পারি। সেনাবাহিনীতে থাকার কারণে আমার ফুটবলার-সামর্থ্যের পুরোটা দিতে পারিনি। শুধু যদি ফুটবলই খেলতাম, তাহলে অন্য কেউ আমার ধারেকাছেও থাকত না।

প্রশ্ন : শেষ খেলেন তো ১৯৭৮ সালে?

---

হাফিজ : ’৭৭ থেকেই খেলা কমিয়ে দিয়েছিলাম। তখন আর আর্মিতে নেই। চার বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করি। সেবার লিগে খেলি অল্প কয়েকটি ম্যাচ। ১৯৭৮ সালে কোচ আশরাফ ভাই এসে বললেন, ‘এবার দল ভালো হয়েছে, তুমি খেললেই চ্যাম্পিয়ন হব।’ লিগের দ্বিতীয় পর্ব পুরোটাই খেললাম মনোযোগ দিয়ে, দল হলো চ্যাম্পিয়ন। অবসরের কথা একটু বলি। আবাহনীর বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলার আগে আশরাফ ভাই বললেন, ‘তুমি তো আলতু-ফালতু ফুটবলার না। পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছ। বাংলাদেশে কেউ মাঠ থেকে অবসর নেয়নি। তুমি দর্শকদের হাততালির ভেতর দিয়ে অবসর নিয়ে নতুন একটি ধারা তৈরি করো।’ তা-ই করলাম।

প্রশ্ন : মোহামেডানে পারিশ্রমিক পেতেন কেমন?

হাফিজ : ১৯৬৭ সালে যোগ দেওয়ার সময় গজনবী ভাইকে বলেছিলাম, বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে আমাকে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দিতে হবে। সেবার পেয়েছিলাম ছয় হাজার টাকা। এরপর তো আর্মিতেই চলে যাই। আর মোহামেডান থেকে টাকা নেব কেন? ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা থেকে বিনা টাকায় খেলে গেছি। ’৭৮ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত কখনোই আর কোনো টাকা নিইনি।

প্রশ্ন : ফুটবলার হাফিজের অ্যাথলেট পরিচয়টা আবার অনেকের অজানা। পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম মানব হয়েছিলেন আপনি। সেই গল্পটি যদি একটু বলতেন?

হাফিজ : আমি যে দ্রুততম মানব ছিলাম, তা তো প্রায় কেউই জানে না। আমার স্ত্রীও জানেন কিনা সন্দেহ। যাই হোক, অ্যাথলেটিকসে আসাটা একেবারে হঠাৎ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ১৯৬৪ সাল। বন্ধুরা বলল, ‘তুমি তো ফুটবল খেল, দৌড়েও নাম দাও।’ রানিং শু নেই, কেডস পরে দৌড়েই ফার্স্ট। বিশ্ববিদ্যালয় দলের অ্যাথলেটিকস কোচ ছিলেন ওটিস কফি নামে এক আমেরিকান ভদ্রলোক। উনি আমার দৌড় দেখে মুগ্ধ। খুব প্রশংসা করলেন। কিন্তু আমার তো দৌড়ে ঝোঁক নেই। ওটিস কফি ছাড়ার লোক নন। বললেন, ‘সাত দিন পর পূর্ব পাকিস্তান চ্যাম্পিয়নশিপ হবে। সেখানে তুমি দৌড়াবে।’ আমি রাজি না। উনি জিপে করে তুলে নিয়ে গেলেন, স্টেডিয়াম থেকে কিনে দিলেন রানিং শু। ওটিস কফির আগ্রহ দেখেই আমি নাম দিলাম। ফার্স্ট হলাম। ১৯৬৪, ’৬৫, ’৬৬—এই তিন বছর সিরিয়াসলি দৌড়েছি। পূর্ব পাকিস্তান চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে স্পর্শ করেছি আগের রেকর্ড টাইমিং; তখন ১১ সেকেন্ড ছিল। ২০০ মিটারের রেকর্ডটি আমি লিখেছিলাম নতুন করে।

প্রশ্ন : ফুটবলে যাঁদের বিপক্ষে খেলেছেন, সেরা কাকে মনে হয়েছে?

হাফিজ : বলতে গেলে মারকানী ফুটবলারদের নামই বেশি করে আসবে। সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর, স্টপার ব্যাক তোরাব আলী, মিডফিল্ডার গফুর—ওরা নিজেদের পজিশনে ছিল এশিয়ার সেরা। ’৬৭ সালে আমি যেবার একমাত্র বাঙালি হিসেবে সুযোগ পেলাম, সেই পাকিস্তান জাতীয় দলের কোচ ছিলেন ডেটমার ক্র্যামার। উনি ’৬৬ বিশ্বকাপে রানার্স-আপ জার্মানি দলে মূল কোচ হেলমুট শোনের সহকারী কোচ ছিলেন। ক্র্যামার মাস দুয়েক আমাদের কোচিং করিয়ে বললেন, তোরাব আলী ও গফুরের জার্মান লিগের যেকোনো দলে খেলার যোগ্যতা রয়েছে। বুঝতেই পারছেন, পাকিস্তান ফুটবলের মান তখন কোথায় ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাকে মুগ্ধ করা একজন ফুটবলারের নাম বলতে হলে বলব নান্নুর কথা। খুব শৈল্পিক ফুটবলার। খুব ভালো ট্যাকল করত, কিন্তু রাফ ট্যাকলিং কখনো না। সালাউদ্দিনও পরে ভালো খেলেছে, করেছে অনেক গোল। এনায়েত আবার পুরো মাঠজুড়ে খেলত, খেলাতে পারত সবাইকে। নান্নুর ভাই মন্জুও খুব ভালো। আর মুন্না। এই কয়েকজনের কথাই বলতে পারি।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের সেরাদের সেরা হিসেবে সালাউদ্দিন-এনায়েতের নাম আসে। আপনার নাম যে আসে না, এ নিয়ে কোনো আফসোস?

হাফিজ : আগে ছিল, এখন আর নেই। ৭২ বছর বয়সে আবার কিসের আফসোস? ওরা মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে কয় গোল দিয়েছে—রেকর্ড ঘেঁটে দেখুন। দুই-তিনটার বেশি না। আমার সেখানে সাত গোল। যুদ্ধের আগে পাকিস্তানের অমন দলে আমিই একমাত্র বাঙালি হিসেবে নিয়মিত খেলেছি। আসলে সালাউদ্দিন-এনায়েতের ব্যাপারটি বানিয়েছেন সাংবাদিকরা। আমি তো বলব, সামর্থ্যের দিক দিয়ে সালাউদ্দিনের চেয়ে নান্নু-মন্জু দুজনই ভালো। কিন্তু তারা তো স্ট্রাইকার না, সে কারণে অমন নাম হয়নি। আর আমি যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে খেলে আবার ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতাম, ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দেইনি—সে কারণে আমার কথা সেভাবে লেখা হয়নি।

প্রশ্ন : কিন্তু বাংলাদেশের শতাব্দীসেরা ফুটবলার হিসেবে ফিফা আপনাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওই ঘটনাটি একটু জানতে চাই।

হাফিজ : ২০০৪ সালে ফিফার একশ বছর পূর্তি হলো। তখন ওরা বিশ্বের সব দেশের কাছে আহ্বান জানাল, তোমাদের দেশের শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের নাম পাঠাও। এরপর ফিফা সেটি যাচাই-বাছাই করে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয় আমার নাম। ওরা সব দেখেশুনে আমাকে দেয় সম্মানটি। ভারতের পিকে ব্যানার্জি, পাকিস্তানে ওমর হয় ওদের দেশের শতাব্দীর সেরা ফুটবলার। ফিফার ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন হাম্মাম বাংলাদেশে এসে আমাকে স্বীকৃতির সার্টিফিকেট দিয়ে যান। এ দেশের ফুটবলের অনেকে আমাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। কিন্তু ফিফা যে শতাব্দীসেরার পুরস্কার দিল, এতে আমি অবশ্যই গর্বিত।

প্রশ্ন : খেলা ছাড়ার পরও তো আপনি অনেক দিন জড়িয়ে ছিলেন ফুটবলের সঙ্গে…

হাফিজ : ১৯৮০ সালে মোহামেডানের ম্যানেজার হয়েছিলাম। ১৯৮২ সালে হই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। চার বছর পর ১৯৮৬ সালে দায়িত্ব নিই বাফুফের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সে দায়িত্বেও ছিলাম চার বছর। বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর এখনকার নির্বাচন দেখে আমার উপলব্ধি, ক্রীড়াঙ্গন থেকে রাজনীতিদের বের করে দেওয়া উচিত। একেবারে নিষিদ্ধ করা উচিত। এখানে নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য লোকদের হাতে ফেডারেশনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তবে আমি যখন বাফুফেতে ছিলাম, তখনই এএফসির সঙ্গে পরিচয় হয় বাংলাদেশের। আমি নির্বাচন করে এএফসির নির্বাহী কমিটির সদস্য, পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছি। গিয়েছি ফিফা কংগ্রেসেও। ১৯৯৪ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিষিদ্ধ মাদক নেওয়ার দায়ে যেবার বহিষ্কার করা হয়, আমি সেবার ছিলাম ফিফা ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে। ছয় মহাদেশ থেকে ছয় প্রতিনিধির মধ্যে এশিয়া থেকে আমি।

প্রশ্ন : ম্যারাডোনার সঙ্গে কোনো স্মৃতি রয়েছে?

হাফিজ : আমাদের আগেই তো আর্জেন্টিনার ফেডারেশন ওকে বহিষ্কার করে। বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের এক আদালতে মামলা হয়ে যায় ফিফা প্রেসিডেন্ট জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জের বিরুদ্ধে। খবরটি নিউ ইয়র্ক টাইমসে পর্যন্ত আসে। পরে তো আমি হ্যাভেলাঞ্জ-ব্ল্যাটারদের দেখলে পালিয়ে থাকি। এমনিতে ম্যারাডোনার সঙ্গে আমার আলাপ হয় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। ফিফার ভেন্যু সমন্বয়ক ছিলেন পিটার ভেলাপ্পান। ও-ই পরিচয় করিয়ে দেয়। ভেলাপ্পান মজার একটি কথা বলেছিল। ম্যারাডোনার নাকি ড্রেসিংরুমে হাতুড়ে কবিরাজ নিয়ে যায়, ধোঁয়া দিয়ে অন্ধকার করে ফেলে। ব্ল্যাক ম্যাজিক করে আর্জেন্টিনার জয়ের জন্য। মজার চরিত্র।

প্রশ্ন : পেলের সঙ্গে?

হাফিজ : ফিফা কংগ্রেসে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে অনেকবার। বন্ধুত্বই হয়ে যায় একরকম। কত বড় ফুটবলার কিন্তু কত বিনয়ী! পেলেকে যখন বলি, ‘তুমি তো সুপারস্টার’, ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘না বন্ধু, খেলাধুলায় সুপারস্টার একজনই—মোহাম্মদ আলী। আমাকে বড়জোর স্টার বলতে পার।’ আমার বড় ছেলের নাম রেখেছি পেলের নাম। ওর ডাকনাম ডিকো, পেলেরও তাই। এটি পেলেকে বলতে দারুণ খুশি হয়েছিলেন।

প্রশ্ন : একটা প্রসঙ্গ তোলা হয়নি। ফুটবল মাঠে আপনার সব সময় মাথা ঠাণ্ডা থাকত বলে জেনেছি। সেই আপনিই নাকি ১৯৭৭ সালে পিডাব্লিউডির বিপক্ষে ম্যাচে রেফারি দলিল খানকে ঘুষি মেরেছিলেন?

হাফিজ : আরে না, ঘুষি মারিনি। ঘটনা হয়েছে কী, পিডাব্লিউডির বিপক্ষে আমরা এক গোলে হারছিলাম। এ নিয়ে মেজাজ ঠিক নেই। অমন সময় ওদের এক খেলোয়াড় এসে আমাকে বাজেভাবে চার্জ করল। উঠে ওর বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘এই ব্যাটা, এমন ফাউল করলি কেন?’ রেফারি দলিল খান এসে আমাকে উল্টো দেখিয়ে দিলেন লাল কার্ড। সচরাচর আমি ফুটবল মাঠে ফাউল করি না, ফাউলের শিকার হলেও কিছু বলি না। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে ওভাবে লাল কার্ড দেখানোয় মেজাজটা এত বিগড়ে গেল যে, জার্সি খুলে সেটি ছুড়ে মারলাম রেফারির মুখে। কাজটি করা আমার ঠিক হয়নি। ওই ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত।

প্রশ্ন : আমরা শেষ দিকে চলে এসেছি। রাজনীতিতে এলেন কিভাবে, একটু জানতে চাই।

হাফিজ : আর্মিতে আমি ভালো অফিসার ছিলাম। পাকিস্তানে আমার কোর্সে প্রথম হয়েছি। সেনাবাহিনীই ছিল আমার ক্যারিয়ার। আর্মিতে ডেপুটি চিফ থাকার সময় জিয়াউর রহমান পর্যন্ত আমার এসিআরে লিখেছিলেন, ‘এই অফিসারকে ভবিষ্যৎ সেনাপ্রধান হিসেবে গড়ে তোলা উচিত।’ কিন্তু স্বাধীনতার পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান মিলিয়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের পর আমাকে দেওয়া হয় বাধ্যতামূলক অবসর। তবু রাজনীতি যে করব, সেটি কখনো ভাবিনি। আমার বাবা পাকিস্তান আমলের তিনবারের এমপি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচন দেখতেও যাইনি কোনো সময়। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া ডেকে বললেন, ‘আর কত ফুটবল খেলবে! আমি নতুন দল করেছি। এখানে যোগ দাও।’ আমি বললাম, ‘স্যার, রাজনীতি আমি করব না। তবে আমাদের কিছু ব্যবসা দেন।’ উনি সেটি দিয়েছিলেন। পরে ১৯৮৬ সালের দিকে আমাদের বন্ধু জেনারেল সাদেক এনএসসির চেয়ারম্যান ছিল। ও বলল, ‘আর কত ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে থাকবে? এবার নির্বাচন করে মন্ত্রী-এমপি হও।’ তখন ভাবলাম, ঠিক আছে করে দেখি। জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৮৬ সালে নির্বাচন করে আমি এমপি হলাম। আব্বার সুনামের কারণে এলাকা থেকে এমপি হওয়া আমার জন্য কঠিন ছিল না। ’৮৮ সালে আবার এমপি হই। ১৯৯১-এর নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আবারও। খালেদা জিয়া তখন ডেকে বললেন, ‘আপনি তো আমাদেরই লোক; এখন আসুন বিএনপিতে যোগ দেন।’ আমি ওই মুহৃর্তে তা করলাম না। তবে দেড় বছর পর আমার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের দল বিএনপিতে যোগ দিই। সেবার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী হই। ২০০১ সালে আবার সরকারে এলে প্রথম থেকেই আমাকে পূর্ণ মন্ত্রী করা হয়। প্রথমে পাট মন্ত্রণালয়, পরে পানিসম্পদ। আরো পরে গিয়ে পানিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় একই সঙ্গে। তবে এই যে ২৫-৩০ বছর হয়ে গেল রাজনীতি করছি, এর প্রতিটি মুহৃর্ত আমার অনুশোচনা হয়েছে। সব সময় খালি মনে হয়, কেন আমি রাজনীতিতে এলাম।

প্রশ্ন : বিয়ে করেছেন কবে?

হাফিজ : ১৯৭২ সালে। আমার স্ত্রীর ভাই মেজর ইকবাল আর্মিতে আমাদের ইউনিটে ছিল। বন্ধু-বান্ধবরা মিলে বিয়েটা অ্যারেঞ্জ করে। আমার স্ত্রীর নাম দিলারা হাফিজ। উনি ইডেন কলেজ, সোহরাওয়ার্দি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। অবসর নিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে। আমাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে শাহরুখ হাফিজ আমেরিকায় পড়াশোনা করে সেখানেই থাকছে। ছোট ছেলে তাহারাত হাফিজ এআইবিইউ-তে পড়ে। মেয়ে শামামা শাহরিন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে এমবিএ করেছে কানাডা থেকে।

প্রশ্ন : একেবারে শেষ প্রশ্ন। জীবন নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার তৃপ্তি কতটা?

হাফিজ : আমার জীবনে তিনটি ক্যারিয়ার। আর্মি, ফুটবল ও রাজনীতি। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলেছি, আর্মির ক্যারিয়ার নিয়ে আমি সবচেয়ে গর্বিত, বিশেষত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কারণে। পরের গর্ব ফুটবল। আমি যদি আর্মিতে না গিয়ে শুধু ফুটবলে থাকতাম, তাহলে বাংলাদেশের লোক ফুটবলার হিসেবে শুধু আমাকেই চিনত। সেরা ফুটবলার হিসেবে অন্য সবার চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকতাম আমি। তবু যা পেয়েছি, তা নিয়ে আমি তৃপ্ত। জীবনের আক্ষেপ বলতে, আর্মি থেকে দুঃখজনকভাবে অবসর নেওয়া। আর ফুটবলে স্বাধীন দেশের জাতীয় দলে খেলতে না পারা। ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না কেন, তবে সব মিলিয়ে নিজেকে কেন যেন আমার খুব দুর্ভাগা মনে হয়।





প্রধান সংবাদ এর আরও খবর

ভোলার কর্ণফুলী-৩ লঞ্চে চাঁদপুরের মোহনায় অগ্নিকাণ্ড ভোলার কর্ণফুলী-৩ লঞ্চে চাঁদপুরের মোহনায় অগ্নিকাণ্ড
উদ্ভাস-উন্মেষ-উত্তরণ এখন দ্বীপ জেলা ভোলায় উদ্ভাস-উন্মেষ-উত্তরণ এখন দ্বীপ জেলা ভোলায়
ভোলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আ’লীগের সমর্থিত প্রার্থী বশীর উল্লাহ সভাপতি, সম্পাদক মাহাবুবুল হক লিটু নির্বাচিত ভোলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আ’লীগের সমর্থিত প্রার্থী বশীর উল্লাহ সভাপতি, সম্পাদক মাহাবুবুল হক লিটু নির্বাচিত
ভোলা জেলা প্রশাসকের সাথে আইনজীবী সমিতির মতবিনিময় ভোলা জেলা প্রশাসকের সাথে আইনজীবী সমিতির মতবিনিময়
চরফ্যাশনে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়লো চট্টগ্রামগামী বাস চরফ্যাশনে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়লো চট্টগ্রামগামী বাস
ভোলায় চারটি সহ সারাদেশে ১৫০ সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ভোলায় চারটি সহ সারাদেশে ১৫০ সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী
ভোলায় ৩৩৫ কোটি টাকার শহর রক্ষা বাঁধ এখন মরণ ফাঁদ! ভোলায় ৩৩৫ কোটি টাকার শহর রক্ষা বাঁধ এখন মরণ ফাঁদ!
ভোলার নবাগত জেলা প্রশাসকের সাথে আইনজীবী সমিতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত ভোলার নবাগত জেলা প্রশাসকের সাথে আইনজীবী সমিতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
ভোলা কাঁচা বাজারের প্রবেশমুখে দোকান নির্মাণ, ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের ক্ষোভ! ভোলা কাঁচা বাজারের প্রবেশমুখে দোকান নির্মাণ, ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের ক্ষোভ!
তজুমদ্দিনে প্রধানমন্ত্রীর উপহার মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ তজুমদ্দিনে প্রধানমন্ত্রীর উপহার মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ

আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

© 2024 দ্বীপের সাথে ২৪ ঘণ্টা Bholar Sangbad, সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত।