শনিবার ● ১০ অক্টোবর ২০১৫
প্রথম পাতা » জেলার খবর » অনিশ্চয়তায় মধ্যে বেড়ে উঠছে ভোলার চরাঞ্চলের মীনারা
অনিশ্চয়তায় মধ্যে বেড়ে উঠছে ভোলার চরাঞ্চলের মীনারা
আদিল হোসেন তপু: যে বয়সে চরাঞ্চলের মিনাদের (মেয়েদের) বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। হাঁসি আনন্দরে মধ্যে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে মীনাদের মত শিক্ষক বা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখার কথা। সেই বয়সে তারা স্কুলের পরিবর্তে বাসায় মায়ের সাথে কাজে সহযোগিতা করে তাদের সময় কাটায়। কেউবা মাছ ধরছে, কেউবা বাড়ীতে অলস সময় কাটাচ্ছে। দারিদ্রতার কারনে চরাঞ্চলের মীনারা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পর্যন্ত পাচ্ছে না। আর তখন বয়সন্দীর নানান সমস্যায় পরছে। চরাঞ্চলের মীনাদের কোন অসুখ হলেও তারা ঠিকমত তখন চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারেনা তাদের পরিবার। চরাঞ্চলের এসকল মেয়েদের পরিবারের বোঝা মনে করছে তখন তাকে অল্প বয়সে শিশু বিবাহ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার কোন কোন মীনাদের দারিদ্র্যতার কারনে তাদের পরিবার বাসা বাড়ীতে কাজে দিয়ে দিচ্ছেন। আর তখন বাসা বাড়ীতে যেয়ে হ্যাপীদের মত নির্যাতনের শিকাড় হয়ে ডাস্টবিনে পরে থাকতে হয়। আবার কাউকে অল্প বয়সে শিশু বিবাহ দিয়ে স্বামীর সংসার করতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর তখনই সৃষ্টি হয় নানা ধরনের সমস্যা। এতো সব অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছে ভোলার চরাঞ্চলের মীনারা।
শনিবার ‘মীনা দিবস’। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘কন্যা শিশু বিয়ে দিয়ে করো নাকো ভুল, প্রত্যেকটি শিশু যেন এক একটি ফুল’।
বিদ্যালয়ে যেতে সক্ষম শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ এবং ঝরে পড়ারোধে সরকারের অঙ্গীকার বদ্ধ। তাই মীনার কার্টুনের মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া মীনাদেরও তাদের পরিবারকে সচেতন করা হয়।
শিশুদের জনপ্রিয় কার্টুন অনুষ্ঠান‘মীনা’ নামের বালিকা চরিত্রটি মেয়ে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়ে ১৯৯২ সালে একজন ১০ বছর বয়সী বালিকা হিসেবে মীনা চরিত্রের সৃষ্টি। সমাজের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা,স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, বিভেদ ও বৈষম্য দূর করে সমৃদ্ধ জাতি গঠনের বার্তাসমূহ বিনোদনমূলক কার্টুন চরিত্র মীনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়।
ইতোমধ্যে অনেক বিষয়ে মীনা কার্টুন পর্ব ও মীনা বই তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে চরিত্রটি শিশু ছাড়াও সব বয়সের মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে।
কন্যা শিশুদের প্রতি সব বৈষম্য দূরীকরণে বিশ্বজুড়ে ‘মীনা আর রাজু’ সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করলেও চরাঞ্চলের হাজারো ‘মীনা’র কাছে মীনা চরিত্রটি একটি নাম মাত্র। মীনার কোনো বার্তাই জানে না চরাঞ্চলের মীনারা। এমনকি এ অঞ্চলের অভিভাবকেরাও এসব তথ্যের বিষয়ে ততটা সচেতন নয়। আর তাইতো চরাঞ্চলের প্রান্তিক জনপদে ‘মীনা’দের চোখে নেই বড় কোন স্বপ্ন। অনিশ্চিত ভবিষৎতের মধ্যে কাটে মীনাদের জীবন।
তবে মীনার এই চরিত্রের কার্টুন সর্ম্পকের কথা জানা নেই ভোলার চরাঞ্চলের মীনাদের (মেয়েদের)।
সরজোমিন ঘুরে দেখা গেছে শহর অঞ্চলের স্কুলের ছেলে-মেয়েরা কিংবা তাদের অভিভাবকরা মীনারা কথা জানলেও মীনার কার্টুন চরিত্রের কথা অজানা চরাঞ্চলের শিশুদের কাছে। ভোলার মদন পুরে প্রথম অলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাবেয়াকে মীনার কার্টুন সর্ম্পকে জিঙ্গাস করা হলে তিনি বলেন, মীনার কাটুনের নাম শুনেছি তবে কি ধরনের কার্টুন দেখানো হয় তা জানিনা। আমাদের চরে বিদ্যুৎ নাই, থাকলে অবশ্যই দেখতে পারতাম। চরের আরেকজন শিশু রাছেল, বাবু সহ আরো মীনার কার্টুন এর কথা জিঙ্গাস করলে তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আর হাসেন। বলেন মীনা তো মেয়েদের নাম।
ভোলার রামদাসপুরের কামাল হোসেন এর মেয়ে আকলিমা। ৫ম শ্রেণীর পর লেখাপড়া বন্ধ। বয়স ১৬ পেরিয়েছে। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সবই করতে হয় ওকে। তিনবেলা ঠিকমত খাবারও জোটে না। বয়সী মেয়ে ঘরে রাখা বাবা-মায়ের জন্য কষ্টকর। তাই মেয়ের বিয়ের উপায় খুঁজছেন বাবা। আকলিমার মা রাবেয়া বেগম বলেন, ‘মোরা গরিব। নদীতে জমি-জমা লইয়া গ্যাছে। মাইয়া তো পড়াইতে পারছি না।’
মীনাকে চেনে কি না, জানতে চাইলে রাবেয়া বেগম মীনার ছবি দেখেছে। কিন্তু তার চরিত্র সম্পর্কে তেমন কিছু শোনেনি। তবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ায় ওর মন খুব খারাপ হয়েছে। ওর লেখাপড়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল।
রামদাসপুরের জান্নাত বেগম বলেন, আমার স্বামী আকবর নদীতে মাছ ধরে। আমাদের ২টি মেয়ে ২ টি ছেলে সন্তান। মেয়েরাও আমার সাথে ঘরে-বাইরে কাজ করে। ২ ছেলে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। দিনের অধিকাংশ সময় ছেলেরা বাবার সাথে মাছধরে । আর মেয়েরা বাড়ীতে আমার সাথে কাজ করে। মীনা-রাজুর কোনো কোন কথাই জানেনা জান্নাত এর মেয়ে আমেনাও রাবেয়ার ।
‘আমি বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে লেখাপড়া শিখে যাই’- মীনার এই গানের গানের সঙ্গে চরাঞ্চলের বহু ছেলেমেয়ে পরিচিত নয়। স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মীনাকে কিছুটা চিনলেও যারা কখনোই স্কুলে যায়নি, তাদের কাছে এই দীর্ঘ সময়েও মীনা অচেনা রয়ে গেছে। ছেলেসন্তানকে বেশি আদর-যতœ করার ধারণা এখনও এই চরাঞ্চলের পরিবারগুলোতে বিদ্যমান। কিন্তু মীনা এই প্রথা ভাঙতে চেয়েছে। সে কারণেই কার্টুনচিত্রে মায়ের অনুমতি নিয়ে মীনা ভাইয়ের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করে নিয়েছিল।
মীনা কার্টুনে মীনা বুঝিয়ে দিয়েছে ছেলেমেয়ে সবাই সমান। সমাজের চোখ বদলাতে চেয়েছে মীনা। দেখানো হয়েছে একটি মেয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে। চরাঞ্চলের দুর্গম জনপদের পরিবারের মেয়েশিশুরাও পরিবারের সমস্যার সমাধান করে, তবে সেটা অন্যভাবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে। এছাড়া বুদ্ধির কৌশলে কোন কাজ করার সামর্থ্য এদের নেই। কিন্তু মীনা বুঝিয়েছে, মেয়েদের প্রতি সমাজের বৈষম্য দূর করতে লেখাপড়া জানাটা খুবই জরুরি।
ভোলার চলাঞ্চলে মীনার কার্টুন কিভাবে পৌছানো যায় এই সম্পর্কে জানতে চাইলে ভোলার শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মো.আকতার হোসেন বলেন, চরাঞ্চলে যেহেতু বিদ্যুৎ থাকেনা। তাই ভাসমান একটি নৌকার ব্যাবস্থা করা দরকার। এই নৌকার মাধ্যমে বিভিন্ন চড়ে যেয়ে তারা মীনার কার্টুন সহ শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য কাজ করবে।
তবে জেলা তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মীনা কার্টুনসহ সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার প্রামন্যচিত্র দেখানোর কথা থাকলেও তা এই প্রান্তিকে আসেনা ।
তবে ভোলার জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা বলেন, আমরা মীনার কার্টুনকে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে ইউনিসেফের এর সহযোগিতায় জেলা তথ্য অফিসার কাজ করে যাচ্ছে। আশারাখি চরাঞ্চলে মীনার কাটুনকে আরো বেশি করে প্রচার করার জন্য আমরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের সহযোগিতা নিয়ে প্রচারের ব্যাবস্থা করবো ।