মঙ্গলবার ● ২ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » জেলার খবর » করোনায় ভোলার স্বাস্থ্য সেবা ও পি.সি.আর. ল্যাব প্রসঙ্গ
করোনায় ভোলার স্বাস্থ্য সেবা ও পি.সি.আর. ল্যাব প্রসঙ্গ
এম. আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী: বর্তমানে সারা বিশ্বে সীমান্ত রক্ষা এবং শক্তি প্রদর্শন ব্যবস্থায় অতি ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাস হাসছে বিদ্রূপের হাসি। বাঘা বাঘা সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা মুক্তির আশায় চেয়ে আছে আকাশপানে। এই বিশ্ব-বিপর্যয়ে আমাদের ছোট্ট ভূখণ্ডের বাংলাদেশও করোনার থাবায় হাঁসফাঁস করছে। যেহেতু আমরাও বিশ্বপল্লীর অন্তর্ভুক্ত। আর এই সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অতীব জরুরি। কভিড-১৯জনিত মহামারির কারণে পৃথিবী কতটা বিপর্যস্ত, তা মানব জাতি প্রত্যক্ষ করছে। পৃথিবীজুড়ে কভিড-১৯ নিয়ে গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সামাধানের চেষ্টা অব্যাহত। এ পরিস্থিতিতে দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় একমাত্র বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলার স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি বড় ভাবিয়ে তোলে।
বিপুল জলরাশিবেষ্টিত ৩৪০৩ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপে প্রায় ২২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করে আসছে। জেলার বিচ্ছিন্ন ২১টি চরে বাস করে প্রায় ৬ লাখ মানুষ। মূল ভূখণ্ডের সাথে সড়ক যোগযোগ নেই মনপুরা উপজেলার। এসব মানুষ অসুস্থ হলে তাদের বরিশাল বা ঢাকা নেওয়াও কষ্টকর। এ ছাড়া এমন কিছু চরাঞ্চল রয়েছে যেখানে আসা-যাওয়াতেই পুরোদিন অতিবাহিত। আবার কোনো কোনো চরাঞ্চলে সপ্তাহে দুই দিন নির্দিষ্ট নৌকা বা ট্রলারে যাতায়াতে। করোনার দুর্যোগে ভোলার সাথে অন্য জেলার যাতায়াত ব্যবস্থাও বন্ধুর। সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধির সতর্কতা তো সবার মাথায় রয়েছেই। ০২ জুন ২০২০ তারিখে দেশে মোট আক্রান্ত ৫২৪৪৫ ও মোট মৃত্যু ৭০৯ জনে। সংক্রমণ ও মৃত্যুও হারও বেড়েই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলার স্বাস্থ্যসেবা কতটা জরুরি, তা সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে।
সদর হাসপাতাল, ১টি টিবি ক্লিনিক, ৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৬২টি ইউনিয়ন ক্লিনিকে ভোলাবাসীর চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও সেবার মান, সীমাবদ্ধতা এবং রোগীর সন্তুষ্টি নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ভোলা সদর হাসপাতালটি ১৯৯৮ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১শ’ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে তা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে নির্মাণ শুরু হয়। বেশ আগেই নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলেও তা চিকিৎসাসেবায় উন্মুক্ত করা হয়নি। এই ভবনটিতে অক্সিজেনের একটি আধুনিক লাইন রয়েছে। করোনা রোগীর প্রচুর শ্বাসকষ্ট হয়। তাই প্রাথমিকভাবে নতুন ভবনটিতে করা অক্সিজেনের লাইনটি সচলসহ হাসপাতাল ভবনটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় না রেখে পুরো হাসপাতাল করোনা রোগীর সেবায় ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা উচিত। প্রতি উপজেলা এবং দুর্গম চরাঞ্চলে সর্বসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতায় মাস্ক ব্যবহার ও হাত ধৌত করার বহুল প্রচারণাও জরুরি। হাত জীবাণু মুক্ত করার ক্ষেত্রে সূফী ওয়াটার তৈরির পদ্ধতি প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। দেহের তাপমাত্রা স্ক্রিনিং ও করোনা ভাইরাস শনাক্তে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাসহ দ্রুত একটি পি.সি.আর. ল্যাব স্থাপন ভোলাবাসীকে এ দুর্যোগকালে নিঃসন্দেহে স্বস্তি দেবে। দ্বীপের রোগীরা প্রাথমিকভাবে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। কমিউনিটি ক্লিনিক এবং উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল। শিশু, নারীসহ সকলের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। নৌ-অ্যাম্বুলেন্সসহ উন্নত চিকিৎসাসেবা উপকূলীয় জেলা ভোলার জন্য অত্যাবশ্যক।
সম্প্রতি কক্সবাজার ও ভোলা জেলায় বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট করোনা ভাইরাস বিষয়ে পরিচালিত একটি জরিপ বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই ৪৯ শতাংশ উপকূলীয় মানুষের। ৭৪ শতাংশ মানুষ আইইডিসিআর এবং এর সেবা, ২৪ শতাংশ মানুষ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্পর্কে অবগত নয়। ৫৬ শতাংশ মানুষ হোম কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে ভুল তথ্য জানে। কোস্ট ট্রাস্ট তার জরিপের ভিত্তিতে ১১টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: উপকূলীয় জেলাগুলোতে করোনা পরীক্ষার সেবা বাড়ানো। ০২ জুন ২০২০ তারিখ পযন্ত ভোলায় ৫৬ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ০২ জন মারা গেছে। জেলায় করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এখানে সরকারি-বেসরকারি কোন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামগ্রিক বিষয় মূল্যায়ন করে সামাজিক সংক্রমণ রোধে কঠোরভাবে নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি এবং পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে অল্প সময়েই তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে তা সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব।
দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য হৃদয়ে দাগ কাটে। তিনি বলেছেন, “আমি অসুস্থ হলে আমাকে বিদেশে নেবেন না; আমার নিজের দেশেই আমি চিকিৎসা নিতে চাই।” দেশের নিজস্ব ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এ রকম চেতনা অনুপ্রেরণাদায়ক। দেশের সর্বত্র উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। বাংলাদেশের “কুইন আইল্যান্ড” নামে খ্যাত, ইলিশের রাজধানী হিসেবে পরিচিত, খাদ্যে উদ্বৃত্ত দ্বীপ জেলা ভোলায় করোনা দুর্যোগে করোনা ভাইরাস শনাক্তে জরুরি ভিত্তিতে একটি পি.সি.আর. ল্যাব স্থাপন করতে হবে। উপকূলীয় জেলা হিসেবে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের রোগীদের সেবায় পর্যাপ্ত নৌ-অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার বিকল্প নেই। ভোলা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে দ্রুত ভেন্টিলেটর স্থাপন করা উচিত। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য জেলার প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশন বেড (৫০ বেডের করোনা ইউনিট) তৈরি করা আবশ্যক বলে মনে করি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগুলো বাস্তবায়নে আশু পদক্ষেপ নিবেন। পি.সি.আর. ল্যাব, করোনা শনাক্তকরণ কিট, ভেন্টিলেশনসহ উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে উপকূলীয় জেলা ভোলা সমৃদ্ধ হয়ে মুক্তির হাসিতে হাসুক।
লেখক: পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং
চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন
ই-মেইল: [email protected]