বৃহস্পতিবার ● ২৯ মার্চ ২০১৮
প্রথম পাতা » শিরোনাম » অপারেশনে উল্টো চোখ গেল ২০ জনের, তদন্তে কমিটি
অপারেশনে উল্টো চোখ গেল ২০ জনের, তদন্তে কমিটি
ডেস্ক: কেউ এক চোখে কিছুটা কম দেখতেন, কারো চোখ দিয়ে ঝরতো পানি কিংবা কারো আবার বয়সের ভারে চোখে নেমে এসেছিল ধূসরতা। এরকম ২৪ নারী-পুরুষ সুস্থতার জন্য গত ৫ মার্চ ভর্তি হয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মেমোরিয়াল হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একেবারেই ভালো দেখতে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই দিনই ২৪ জন রোগীর একটি করে চোখের অপারেশন করিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর চিকিৎসকের ভুলে এখন ২০ জন রোগী একটি করে চোখ হারিয়েছেন।
এমন ঘটনায় চুয়াডাঙ্গায় রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই অপারেশনের দায়িত্বে থাকা ডা. মোহাম্মদ শাহীন চুয়াডাঙ্গা থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বুধবার তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, সদর হাসপাতালের চক্ষু কনসালটেন্ট ডা. শফিউজ্জামান সুমনকে প্রধান করে তিন সদস্যর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ মার্চ চুয়াডাঙ্গা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক হাসপাতালে ২৪ জন রোগীর একটি করে চোখে অপারেশন করা হয়। অপারেশনের একদিন পরই ছাড়পত্র (রিলিজ) দিয়ে রোগীদের বাড়িতে পাঠানো হয়।
অপারেশন করা রোগীরা জানান, বাড়িতে ফেরার ওই দিনই চোখে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলে তারা একে একে ২০ জনই পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রাথমিক পরীক্ষায় ধরা পড়ে চোখে ইনফেকশন হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া গ্রামের ওলি মোহাম্মদ বলেন, চোখের তীব্র যন্ত্রণায় অবস্থা বেগতিক দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের ২০ জনকে গোপনে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউ ও ভিশন আই হাসপাতালে নেন। সেখানে নিয়ে চিকিৎসা দিয়েও আমাদের চোখকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। পরে অপারেশন করে চোখ তুলে ফেলা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাইদঘাট গ্রামের প্রতিবন্ধী গোলজার হোসেন জানান, সামান্য দর্জির কাজ করে সংসার চালাতাম। বাম চোখ দিয়ে পানি পড়তো। এ কারণে খুব কষ্ট করে তিন হাজার টাকা জোগাড় করে হাসপাতালে চোখ অপরারেশন করাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার ও হাসপাতালের ভুলে একটি চোখ হারিয়েছি। অন্য চোখটিতেও ইনফেকশন দেখা দিয়েছে।
চোখ হারিয়ে আরো যারা হতাশায় ভুগছেন, তারা হলেন- চুয়াডাঙ্গা গাইদঘাটের গোলজার হোসেন, আলুকদিয়ার ওলি মোহাম্মদ, আলমডাঙ্গার বাড়াদী এনায়েতপুরের খন্দকার ইয়াকুব আলী, খাসকররার লাল মোহাম্মদ, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার সোনাপট্টির আবনী দত্ত, আলমডাঙ্গা মোড়ভাঙ্গার আহমেদ আলী, হারদীর হাওয়াতন, দামুড়হুদা লক্ষ্মীপুরের তৈয়ব আলী, মদনার মধু হালদার, আলমডাঙ্গা নতিডাঙ্গার ফাতেমা খাতুন, খাস-বাগুন্দার খবিরন নেছা, জীবননগর সিংনগরের আজিজুল হক, দামুড়হুদা চিৎলার নবীছদ্দিন, মজলিশপুরের সাফিকুল ইসলাম, আলমডাঙ্গা রংপুরের ইকলাস, দামুড়হুদা কার্পাসডাঙ্গার গোলজান, সদাবরীর হানিফা, আলমডাঙ্গা স্টেশনপাড়ার কুতলি খাতুন, কুটি পাইকপাড়ার উষা রাণী ও দামুড়হুদার বড় বলদিয়ার আয়েশা খাতুন।
এদিকে অপারেশনে ২০ জনের দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঘটনাটি বুধবার জানাজানি হলে চুয়াডাঙ্গায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অনেক রোগীর স্বজনরা ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে বুধবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন খায়রুল আলমের নির্দেশে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে তিন সদস্যর একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।
তদন্ত টিমের প্রধান করা হয়েছে সদর হাসপাতালের চক্ষু কনসালটেন্ট ডা. শফিউজ্জামান সুমনকে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- সদর হাসপাতালের কনসালটেন্ট সার্জন ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়ন ও কার্ডিওলজিস্ট কনসালটেন্ট ডা. আবুল হোসেন।
সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম জানান, বিষয়টি জানার পর বুধবার বিকালে আমি নিজেও হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে- কোনো জীবাণু থেকেই রোগীদের চোখে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানতে চাইলে ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডা. শফিউল কবির জিপু ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ৪ ও ৫ মার্চ দু’দিনে মোট ৬০ জন রোগীর চোখের অপারেশন করা হয়। কিন্তু ৫ মার্চ অপারেশন করা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে ছাড়পত্র দেয়ার পর দেখা যায় ২০ জনের চোখে ইনফেকশন। দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য ইম্প্যাক্টের খরচে তাদের ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও ভিশন আই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়।
তিনি জানান, একই সঙ্গে কেন চোখে ইনফেকশন হলো তা জানতে ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে ব্যবহৃত ওষুধ-পথ্য পরীক্ষার জন্য আইসিসিভিডিআরবি-তে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওরাবুলু নামের ব্যবহৃত কিডসে জীবাণুর অস্তিত্ব রয়েছে। এ থেকেই অপারেশেনর রোগীদের চোখে ইনফেকশন হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।
ডা. জিপু আরো বলেন, ঢাকাতেও যখন রোগী পাঠানো হয়, তখন ওই রোগীদের চোখের ইনফেকশনের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে একই জীবাণুর নমুনা পাওয়া যায়।
এবিষয়ে অপারেশনের দায়িত্বে থাকা ডা. মোহাম্মদ শাহীনের বক্তব্য জানতে বুধবার সন্ধ্যায় তার মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনার পর থেকেই তিনি চুয়াডাঙ্গার বাইরে অবস্থান করছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ জানান, বিষয়টি আসলেই স্পর্শকাতর। এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তদন্ত প্রতিবেদন হাতেই পাওয়ার পরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
-পিডি/এফএইচ