সোমবার ● ৬ মার্চ ২০১৭
প্রথম পাতা » পাঠকের মতামত » বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি ও আমরা
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি ও আমরা
সিরাজী এম আর মোস্তাক: বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা নীতি চিরন্তন ও যুগোপযোগী। তিনি ১৯৭১ এর ২৬ মার্চের আগেই তা স্পষ্ট করেন। দেশের সকল জনতাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন। ৭ই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন ও ঘোষণা করেন, “তোমরা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের কিছু করতে পারবেনা।” ২৩ মার্চ (১৯৭১) আওয়ামী লীগের গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেন, “সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি ঐক্যবদ্ধভাবে যে আন্দোলন শুরু করেছে, দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা থামবে না। একজন বাঙালীও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাঙ্গালিরা শান্তিপূর্ণভাবে সে অধিকার আদায়ের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত।”(কামাল হোসেন, “তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর”, পৃষ্ঠা-২৪৫, ঢাকাঃ অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৮)। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী দেশে ফিরে লাখো জনতার সামনেও তিনি একই ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও। আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন এবং দেশ স্বাধীন করেছেন। এ স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আজ আপনাদেরই।” বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিটি ভাষণে শহীদ-গাজী নির্বিশেষে দেশের সকল জনতাকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মাত্র ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে বিশেষ খেতাব দেন আর সবাইকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেন। একজন বন্দি ও আত্মত্যাগী যোদ্ধা হিসেবে নিজেও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন। তাঁর সময়ে দেশে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা-শহীদ-আত্মত্যাগী পার্থক্য ছিলনা। মুক্তিযোদ্ধা, পঙ্গু ও যুদ্ধাহতদের জন্য ভাতা ও কোটাসুবিধা ছিলনা। দেশের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের স্বজন বিবেচিত ছিল। এটাই বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি।
আমরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা মাত্র দুই লাখ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছি। তাদেরকে ভাতা প্রদানসহ তাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদেরও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সম্মান করছি। আমাদের ধারণা, শুধু তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরাই মুক্তিযোদ্ধা। তারাই দেশ স্বাধীন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চারনেতা, সেনাপ্রধান এম.এ.জি ওসমানী, লাখো শহীদ, বন্দি, আত্মত্যাগী, শরণার্থী ও যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারী কোটি কোটি কষ্টভোগী সংগ্রামী বীরেরা মুক্তিযোদ্ধা নন। তারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নয়। অথচ তারাই আমাদের স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর সন্তানেরা মুক্তিযোদ্ধা কোটাভুক্ত নয়। জাতীয় চারনেতার সন্তানেরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটাভুক্ত নয়। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনও মুক্তিযোদ্ধা নয়। তারা কেউ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নয়। তারা শুধু মুখে মুখেই। যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারি কোটি জনতার ভূমিকা ও কর্মকান্ড নিয়ে নতুনকরে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই চলছে। বলা হচ্ছে, তারা পাকবাহিনী থেকে রক্ষায় কেউ লড়াই করেছে আর বেশিরভাগ রাজাকারি করেছে। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা নয়। লাখ লাখ শরণার্থী ও বঙ্গবন্ধুর ন্যায় আটক ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধা নয়। ভারতসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের অসংখ্য লড়াকু বীরও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নয়। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা শুধু দুই লাখ নির্ধারিত।
বিএনপি-জামাতের লুটপাটকারি সরকার ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে। তারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা নিয়ে ব্যাপক বাড়াবাড়ি করে। দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক বিভাজন সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সম্মিলিত জনতা তাদের বিতাড়ন করে। বর্তমান সরকারও একইভাবে ত্রিশভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি শতভাগ বাস্তবায়ন করেছে। ষোলকোটি নাগরিককে বঞ্চিত করে মাত্র দুই লাখ তালিকাভুক্ত পরিবারকে ত্রিশভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসুবিধা দিয়েছে। এটি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি বিরূদ্ধ।
এখন বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা নীতি বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীরা বিশাল স্বার্থ হারাবে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বেড়ে ত্রিশ লাখ থেকে অনেক বেশী হবে। দেশের সকল নাগরিক মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা বাতিল হবে।
আজ বঙ্গবন্ধু থাকলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসমস্ত অনাকাঙ্খিত বিভাজন হতোনা। লাখো শহীদ তালিকা-বহির্ভূত থাকতোনা। মাত্র দুই লাখ পরিবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা-সুবিধা পেত না। বর্তমান ষোল কোটি নাগরিক সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য বিবেচিত হতো।
শিক্ষানবিস আইনজীবি, ঢাকা।
[email protected]