শুক্রবার ● ১ জুলাই ২০১৬
প্রথম পাতা » চাকরির খবর » কিশোরদের অপরাধের দায় আমাদেরও…
কিশোরদের অপরাধের দায় আমাদেরও…
কিশোর অপরাধ সব দেশে সব কালেই ছিল এবং আছে। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের হার রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অপরাধের মাত্রা ও ধরনও সবাইকে ভাবাচ্ছে। হেন অপরাধ নেই, কিশোর-তরুণেরা জড়িয়ে পড়ছে না। গত কিছুদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের আনাচে কানাচে এমন কিছু কিশোর অপরাধের ঘটনা ঘটেছে যা দেশে ও বিদেশে আলোচিত হচ্ছে। সর্ব-সম্প্রতি হবিগঞ্জে রুহুল আমিন রাহুল নামের এক কিশোর প্রকাশ্যে এক কিশোরীকে চড়-থাপ্পড়, কিল ঘুসি মেরে হয়ে গেছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ঢাকার রাস্তায় শনিবার এক বখাটে তরুণ ও তার সঙ্গীরা এক কলেজছাত্রীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। কিল-ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ইট দিয়ে মাথাও ফাটিয়ে দিয়েছে। পরে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
দিনকয় আগে সহপাঠী কিশোরেরা এক মাদ্রাসাছাত্রকে জবাই করেছে —বিদেশি সিরিয়াল দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে।
পত্রিকায়, অনলাইনে বা ফেসবুক-টুইটারের মাধ্যমে যতো ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে, আসলে ঘটনা ঘটছে তারও চেয়ে অনেক বেশি। লোক জানাজানির ভয়, সামাজিক অবস্থার কারণে মেয়েদের পরিবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা চেপে যায় বা মুখ বুজে সয়ে যায়। ঢাকার কলেজছাত্রীটির পরিবারও এ নিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ বা মামলা করেনি।
কেন কিশোর-তরুণদের মধ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে অপরাধপ্রবণতা? পরিবারগুলো কি দেখছে না কেন সবার চোখের সামনে একটা কিশোর বখে যাচ্ছে, কেন ইভটিজার হয়ে উঠছে? কেন ছিনতাই-রাহাজানি–খুনোখুনিতে মেতে উঠছে?
দারিদ্র্য, বাবা-মার সঠিক পরিচর্যার অভাব, বাবা-মার দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ-ভাঙনসহ নানা কারণ কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। পরিবারের বন্ধন, মূল্যবোধ সব কিছু যেন ভেঙে যাচ্ছে এই সময়ে এসে। ব্রোকেন ফ্যামিলির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। আর এসবের ধাক্কাটা গিয়ে লাগছে শিশুদের ওপর।
ছেলেমেয়েদের বয়:সন্ধিকালটাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা সংকটের সময় বলেই দেখিয়েছেন। শিশু-মনস্তত্ত্ববিদের মতো তিনি কতো নিখুঁতভাবেই না এই বয়সের সংকটকে তার ‘ছুটি’ গল্পে তুলে ধরতে পেরেছেন:
‘‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহেরও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে।…
…তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।’’
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতাংশের শেষ বাক্যটি পীড়াদায়ক বা নির্মম শোনাতে পারে। কিন্তু সেটাই সত্য। পড়াশুনা করে, সৃজনশীল কাজে, সবার আদরে আনন্দে যার বড় হয়ে ওঠার কথা যার সে কেন ‘প্রভুহীন পথের কুকুর’ হয়ে যায়? পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যতদিন পর্যন্ত নিজেদের দায়িত্বটা পালন না করবে ততদিন লাখো লাখো রুহুল আমিনে ছেয়ে যাবে দেশ।
হবিগঞ্জের বিপথগামী কিশোর রুহুলকে ‘কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে’ পাঠানো হয়েছে। শুনতে বেশ ভালোই শোনায়। কিন্তু একেকটা কিশোর সংশোধনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে নিপীড়নের নরক—সে খোঁজ কে রাখে!
বছরখানেক আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খেদ করে লিখেছিলেন:
‘‘…আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থার চাপে বা প্রভাবে ‘সংশোধন কেন্দ্রগুলো’ হয়ে গেল ‘উন্নয়নকেন্দ্র’। কিন্তু নামই শুধু পরিবর্তন হলো, না হলো কিশোর-কিশোরীদের উন্নয়ন, না বদলাল কেন্দ্রগুলোর চরিত্র। ১০-১১ বছর আগে যে অবস্থা দেখে এসেছিলাম, এখনো সেই অবস্থাই…।’’
কিশোর, কিশোরীকে যদি বিশাল পাঁচিলের মাঝখানে আবদ্ধ করে রাখা হয়, তাহলে সে ক্রমশ মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে থাকে। সে যদি পেট ভরে খেতে না পায়, রাতে ছারপোকার যন্ত্রণায় ঘুমোতে না পারে, অসুখে চিকিৎসা না পায়, জেল কর্মকর্তা বা তত্ত্বাবধায়কের প্রহারে আহত হয়, তাহলে কীভাবে তার সংশোধন হবে, কীভাবেই হবে তার মনের ‘উন্নয়ন’?
উন্নত দেশে আজকাল কিশোর অপরাধীদের আটকে না রেখে প্রবেশন, প্যারোলসহ নানা বিকল্পের ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা চাই, আমাদের বিপথগামী কিশোরেরাও সুপথে ফেরার সুযোগ পাক। সে ব্যবস্থা আমাদেরকেই করতে হবে। শিশু-কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার কারণগুলো দূর করার কাজে নেমে পড়তে হবে আমাদের। আমরা যেন ভুলে না যাই—‘‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করো।’’