বুধবার ● ২৫ মে ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » তজুমদ্দিনে ধ্বংসস্তুপে চলছে বাঁচার লড়াই, তিন সহস্রাধিক মানুষ খোলা আকাশের নিচে
তজুমদ্দিনে ধ্বংসস্তুপে চলছে বাঁচার লড়াই, তিন সহস্রাধিক মানুষ খোলা আকাশের নিচে
বিশেষ প্রতিবেদন: ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে তজুমদ্দিন উপজেলা সদরে ঢুকতেই তজুমদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সামনে বিশাল একটি রেইনট্রি আড়াআড়িভাবে প্রধান সড়কে পড়ে রয়েছে। তিন-চারজন শ্রমিক করাত দিয়ে গাছটি কাটার চেষ্টা করছে। আর সেই গাছের দুই পাশে বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস, মাইক্রোবাস, রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে প্রবল ঝড়ে এ গাছ রাস্তায় পড়ে যায়। এর প্রায় ১০ হাত দূরেই সড়কে পড়ে থাকা বিশাল একটি গাছ কেটে টুকরো করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। কিছুদূর এগোনোর পর সড়কের বাঁ পাশে দেখা যায়, তজুমদ্দিন সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান গেটের দেয়ালের ওপরে হেলে পড়েছে আরো একটি বিশাল রেইনট্রি। সেই গাছও কাটার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার ডান পাশে দেখা গেল শশীগঞ্জ উত্তর জামে মসজিদের ভেঙে যাওয়া দরজা-জানালার স্তুপ পড়ে রয়েছে মসজিদের সামনেই। তার সামনে বিশাল একটি রেইনট্রি আড়াআড়িভাবে পড়ে রয়েছে দোকানঘরের ওপরে। এতে চুরমার হয়ে গেছে ওই দোকান। উত্তর বাজার ও দক্ষিণ বাজারের বেশির ভাগ দোকানের চাল উড়ে গেছে। দোকানের বেড়া ভেঙে গেছে। ক্ষত-বিক্ষত বাজারের সামনেই ব্যবসায়ীরা তাদের অবশিষ্ট কিছু মালামাল রোদে শুকাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী তাদের নিজ উদ্যোগে দোকানঘর মেরামতের চেষ্টা করছে। এমন খন্ডচিত্রই বলে দিচ্ছে ভয়াবহ ঝড় কী প্রলয়কা- ঘটিয়ে গেছে তজুমদ্দিনসহ ভোলা জেলার অনেক স্থানে। গাছপালা, বাড়িঘর, দোকানপাট, স্কুল, মাদ্রাসা তছনছ হয়ে গেছে ঝড়ে।
এলাকা ঘুরে ঝড়ের ভয়াবহ ছোবলের দৃশ্যের সঙ্গে চোখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছে, জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকা পরিদর্শন ছাড়া আর কিছ্ইু হয়নি। ৫ দিন ধরে এমন মানবেতর পরিস্থিতিতেও তারা কোনো ধরণের সহযোগিতা এখনো পায়নি।
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ব্যবসায়ীদের : তজুমদ্দিন সদরের প্রসিদ্ধ বাজার উত্তর বাজার ও দক্ষিণ বাজার। এখানে লাখ টাকার পুঁজি থেকে শুরু করে কোটি টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করছে এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা তিন শতাধিক। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানায়, শুক্রবার রাত ৩টার দিকে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে বাজারের তিন শতাধিক ব্যবসায়ীর দোকানই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মালামাল মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বলে দাবি তাদের।
উত্তর বাজারের কার্তিক স্টোরের স্বত্বাধিকারী কার্তিক সাহা জানান, শুক্রবার রাত ৩টার দিকে হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঝড় শুরু হয়। মুহূর্তেই সব তছনছ হয়ে যায়। ঝড়ে তাঁর দোকানের চাল উড়ে গেছে। ঝড়ের দাপট শেষ হতেই বৃষ্টির কারণে দোকানের সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। দোকানের পেছনেই তাঁদের বসতঘর। সেই ঘরও ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। জান বাঁচানোই যেখানে সম্ভব হচ্ছিল না সেখানে সম্পদ রক্ষার কথা ভাবারও উপায় ছিল না। ঝড়ে তাঁদের ১০-১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ড সরকারি কিংবা বে-সরকারিভাবে কেউ কোনো সহায়তা করেনি। তাই নিজেদের উদ্যোগেই দোকানঘর মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে। দেখা যাক কত দূর পারি।’
মেসার্স মদন মোহন সাহা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী অরুণ কুমার সাহা জানান, ঝড়ে তাঁর দোকানের টিনের চাল উড়ে গেছে। দোকানের মালামাল রক্ষা করার উপায় ছিল না। পেছনেই তাঁর বসতঘর। এ ঘরের চালও উড়ে গেছে, বেড়া ভেঙে গেছে। এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি।
দক্ষিণ বাজারের মদিনা পার্টস স্টোরের স্বত্বাধিকারী রুবেল জানান, ঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি তাঁর দোকানের ওপরে পড়ে দোকান ভেঙে গেছে। এতে তাঁর দোকানের মালামাল ক্ষতিগ্রসত হয়েছে। এ ছাড়া সাইডে দোকানের মালামালের গুদামের আটটি চাল ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে পাশের একটি পুকুরে ফেলে দেয়। এতে তাঁর অন্তত ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কসমেটিকস দোকানের ব্যবসায়ী জামাল জানান, ঝড়ে তাঁর দোকানের চাল উড়ে গেছে। এতে তাঁর প্রায় তিন লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে।
ফাস্ট ফুডের দোকানি মনোহর জানান, ঝড়ে তাঁর দোকানের ফ্রিজ ও সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘এখন কিভাবে দোকান মেরামত করব আর কিভাবেই বা দোকানে মালামাল তুলব।’ এমন দুর্যোগে তিনি কখনো পড়েননি বলেও জানান।
শাহিন ইঞ্জিনিয়ার ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী শাহিন জানান, ঝড়ে তাঁর দোকান ধসে গেছে। এ ছাড়া ওয়েল্ডিং মেশিন ও জেনারেটর পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন দুশ্চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক করতে পারেন না বলেও মন্তব্য তাঁর।
খোলা আকাশের নিচে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, ত্রাণের জন্য হাহাকার : ঝড়ের আঘাতে তজুমদ্দিন বাজারের পাশেই চাঁদপুর ইউনিয়নের শশীগঞ্জ গ্রামের কয়েকটি ওয়ার্ডের অধিকাংশ টিনের ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেক ঘরের চাল উড়ে গেছে। কিছু ঘরের চাল ও বেড়া দুটোই ভেঙে গেছে। আবার কিছু ঘরের চাল ও বেড়া টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেছে। সরেজমিনে গিয়ে একটি ঘর দেখে মনে হলো দা কিংবা ধারালো কিছু দিয়ে কেউ কেটে টুকরো টুকরো করে রেখেছে। বেশ কিছু ঘরের ওপরে গাছ পড়েছে। অনেক ঘরের ওপরে আবার বিদ্যুতের খুঁটি পড়েছে। বেশ কয়েকটি বসতঘরের ভিটা ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে ঘর ছিল।
বিধ্বস্ত এলাকায় গিয়ে মানুষের চরম দুর্গতির দৃশ্য চোখে পড়ে। বসতঘরের সামনে কেউ তোশক ও বালিশ শুকাচ্ছে। অনেকে আবার শুকাচ্ছে চাল-ডাল ও বই-খাতা। অনেকেই তিন দিন ধরে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। না খেয়ে অনেক শিশু অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।
বাজার থেকে স্লুইসগেট যাওয়ার রাস্তার পাশে দেখা গেল শশীগঞ্জ গ্রামের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে রিকশাচালক আনোয়ার হোসেনের সাত বছরের ছেলে সিয়াম। তার মা পারুল বেগম জানান, ঝড়ের পর থেকেই তাঁরা খোলা আকাশের নিচে। ভয়ে এবং না খেয়ে অসুস্থ হয়ে তাঁর সন্তানের মরার দশা।
তজুমদ্দিন মডেল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র সিয়ামকে নিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। পারুল বেগম বলেন, ‘খোলা আকাশের নিচে তিন দিন আমরা না খাইয়া রইছি। কেউ আমাগোর খবর নিল না। কেউ কোনো টাহা-পয়সা খাওন-দাওন দেয় নাই।’
পাশেই বিধ্বস্ত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জেলে নাগর মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার ঘর তো ভেঙে গেছেই, আমার তিন ছেলে-মেয়ের বাই-খাতাও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।’ নাগর মিয়ার মেয়ে তজুমদ্দিন ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী জান্নাত আক্তারকে দেখা গেল তার ভিজে যাওয়া বই-খাতা রোদে শুকাতে।
একই ওয়ার্ডের দিনমজুর আবদুল জলিল বলেন, ‘আমাগো রান্নাঘর শেষ। ঝড়ে শোবার ঘরডাও কাইত কইর্যা পুবে হ্যালাইয়া দিছে।’ তাঁর স্ত্রী নাছিমা বেগম বলেন, ‘রশিঘরের (রান্নাঘর) চাল-ডাল কিচ্ছু নাই। ছেলে সুমনের ঘর থাইক্যা ভাত আইন্যা স্বামী ও মাইয়া পোলাগোরে খাওয়াইছি। তিন দিনে আমরা কোনো ত্রাণ পাইনি।’ আলী আহাম্মদ বলেন, ‘আমরা নদীভাঙা মানুষ। জমিজমা কিছু নাই। ভাত খুঁজিখাঁজি খাই।’
ওই ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার নুর হাফেজ বলেন, ‘ঝড়ে আমার ওয়ার্ডে তিন শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি।’ যদিও ২৫ মে ত্রাণমন্ত্রী এসে ত্রাণ সমাগ্রী বিতরণ করেছেন, কিন্তু তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম।
স্থানীয় লোকজন জানায়, ঝড়ের আঘাতে উপজেলার বিধ্বস্ত পাঁচ শতাধিক বসতঘরের ক্ষতিগ্রস্ত তিন সহ¯্রাধিক মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছে এসব মানুষ।
বিদ্যুৎ থাকবে না আরো সাত দিন : ঝড়ের আঘাতে তজুমদ্দিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে ও খুঁটি উপড়ে পড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে তিন দিন ধরে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে পুরো উপজেলার বাসিন্দা। ওই বৈদ্যুতিক তার ও খুঁটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী জানান, আরো অন্তত সাত দিন বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হতে পারে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজনকে।
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করেনি প্রশাসন : গত শুক্রবার দিবাগত রাতে তজুমদ্দিনে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও তিন দিনেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কোনো তালিকা তৈরি করতে পারেনি প্রশাসন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নিরূপণ করতে পারেনি তারা।
প্রশাসনের ভাষ্য : তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিক তৈরি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে। তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শনিবার ও রবিবার জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে কিছু চাল বিতরণ করা হয়েছে। তাদের মাঝে আরো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে। আপাতত জনপ্রতি ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হচ্ছে।
দুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক সেলিম উদ্দিন বলেন, ঝড়ের আঘাতে তজুমদ্দিন ধারণার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, দু-এক দিনের মধ্যেই প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্তকে ত্রাণ দেয়া হবে।